ওঁরা চার জন। এক জনের স্বপ্ন, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পাশ করে নিজের ফার্ম খুলবেন। বাকি তিন জনের স্বপ্ন, রিমোট সেন্সিং নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করে দেশে বা বিদেশে চাকরি করা। চলতি বছরে চার জনেই সাম্মানিক স্নাতক পাশ করেছেন।
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সির চূড়ান্ত পর্বের প্রস্তুতির মধ্যেই চলতি বছরে কাশীশ্বরী কলেজ থেকে হিসাবশাস্ত্রে সাম্মানিক স্নাতক পাশ করলেন প্রিয়া কুমারী। শতাংশের হিসাবে সত্তরের ঘরে তাঁর নম্বর। প্রিয়ার তিন বন্ধু গীতা রায়, প্রিয়াঙ্কা সরকার ও রিনা দাস ইস্ট ক্যালকাটা গার্লস কলেজ থেকে ভূগোলে সাম্মানিক স্নাতক পাশ করেছেন। প্রত্যেকের প্রাপ্ত নম্বর প্রায় ৬০ শতাংশ।
চার কন্যাকে আদতে সাধারণ মনে হলেও ওঁদের যাত্রাপথটা অ-সাধারণ। কারও বাবা-মা নেই, কারও পথের ধারে প্লাস্টিকের ঘরে এক বেলা খাবার জুটত না। উচ্ছ্বসিত মেয়েদের এই সাফল্যের কান্ডারি, দমদম স্টেশনের কান্তা চক্রবর্তী। স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে ১৮ বছর আগে মেয়ে পথশিশুদের নিয়ে শুরু করেন তাঁর পাঠশালা। ওঁদের ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সেই দীর্ঘ পথ চলছেন। এলাকায় পরিচিত ‘কান্তা দিদিমণি’ নামেই। এক দিন যিনি মমতা আর কড়া অনুশাসনে ওঁদের আগলে রেখে পাঠ দিয়েছেন, আজ তিনিই ওঁদের থেকে বুঝে নেন রিমোট সেন্সিংয়ের খুঁটিনাটি। গীতা বুঝিয়ে দিলেন, উপগ্রহ চিত্র কম্পিউটারে ফেলে বিশেষ পদ্ধতিতে ম্যাপ তৈরি করার পাঠ আর খুঁটিনাটি শেখানো হয় এই বিষয়ে। যার সাহায্যে ভূ-চিত্র ধরা পড়বে। কোথায় কত অংশ জল-অরণ্য আছে, তা জানতে অথবা গাছ ও পশুর সমীক্ষায়ও ব্যবহার হয় রিমোট সেন্সিং।
ওঁদের চার জনের শৈশবটা প্রায় একই রকম। দমদম স্টেশন ও তার আশপাশে খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতেন ওঁরা। ছোট বয়সেই কোনও ভাবে কান্তা দিদিমণির কাছে পৌঁছে যান। সেই থেকে তাঁর স্নেহেই বেড়ে উঠছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি চার জনেই আঁকতে ভালবাসেন। ক্যারাটের ইয়েলো ও গ্রিন বেল্ট রয়েছে চার কন্যার ঝুলিতে। তবে গান শোনা, সিনেমা দেখার সময় বা সুযোগ নেই।
সিএ-র চূড়ান্ত পর্বের জন্য এক বছর ধরে একটি ফার্মে যুক্ত আছেন প্রিয়া। ভোরে ঘুম থেকে উঠে কলেজ। দিদিমণির বানানো টিফিন খেয়ে কলেজ থেকে সোজা অফিস। ফিরতে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। এর পরে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত পড়াশোনা করে, খেয়েদেয়ে ঘুমোতে যাওয়া। এই ছিল নিত্যদিনের রুটিন। ভূগোল নিয়ে পড়তে গিয়ে কম দৌড়ঝাঁপ করেননি রিনা-প্রিয়াঙ্কা-গীতাও। দ্বিতীয় সিমেস্টারে প্রথম রিমোট সেন্সিংয়ের ধারণা হলেও ইচ্ছেটা পোক্ত হয় পঞ্চম সিমেস্টারে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানার পরেই।
রিমোট সেন্সিং পড়ানোর খোঁজে মেয়েদের নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন কান্তাদি। তবে চিন্তা বাড়াচ্ছে পড়ার খরচ। ‘‘ওদের যখন এত ইচ্ছে, যত কষ্টই হোক, পড়াব। পাশে কিছু শুভানুধ্যায়ী থেকেছেন, তাঁদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। স্টেশনের হকারভাই, রেল ও পুলিশের আধিকারিকেরা, বিশেষ করে জোড়াবাগান থানার ওসি-সহ অনেকে আছেন। প্রিয়ারা নিজের পায়ে দাঁড়ালে বাকিছোটদের কাছে ওরা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সেটাই আমার সেরা পুরস্কার।’’ —বললেন কান্তা।
প্রিয়ার পাখির চোখ ২০২৭ সালের সিএ ফাইনাল। সেটা পাশ করলেই নিজের ফার্ম, নিজের কিছু। তাই অন্য বিষয়ে মন নেই ওঁর।
তা হলে খোলা আকাশের নীচেও স্বপ্ন দেখা যায়! পথ প্রদর্শক আর স্বপ্নসন্ধানী দুইয়ের মেলবন্ধনে তৈরিও হতে পারে সেই রূপকথার বাস্তব।