• মেয়ে ফিরলে মাংস রেঁধে খাওয়াতে চান, অনুপর্ণার ভেনিস জয় নিয়ে উচ্ছ্বসিত মা
    প্রতিদিন | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: বাঙালি মেয়ের জয়জয়কার চতুর্দিকে। আমরা জানি নবাগত বাঙালি চিত্রপরিচালক অনুপর্ণা রায় ৮২তম ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের অরিজন্তি বিভাগে তাঁর ছবি ‘সংস অফ ফরগটেন ট্রিজ’-এর জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। জুরি প্রেসিডেন্ট জুলিয়া ডুকর্ন এই পুরস্কার ঘোষণা করেন। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে পুরস্কার গ্রহণের সময় ইমোশনাল অনুপর্ণা তাঁর এই জয়কে ‘সুরিয়াল’ বলে চিহ্নিত করেন। কিন্তু তাঁর এই জয় এত সহজ ছিল না। তাঁর এই কাজে প্রথম দিকে তাঁর পরিবারের সায় ছিল না। তবু অনুপর্ণা তাঁর লক্ষ্যে স্থির ছিলেন। তিনি ছবি করবেন ঠিক করেই নিয়েছিলেন। কোনও বাধাই তাঁকে আটকাতে পারেনি। পুরুলিয়ার নারায়ণপুর গ্রামের মেয়ে এদিন ভেনিসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর দেশ, তাঁর জন্মস্থান, তাঁর দেশের বাড়ির প্রতি এই পুরস্কার উৎসর্গ করেন এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে, প্যালেস্তাইনে যুদ্ধ নিপীড়িত অবস্থার কথা মনে করিয়ে দেন।

    কেমন ছিল অনুপর্ণার বাড়ির পরিস্থিতি?অনুপূর্ণার মায়ের মুখে জানা গেল অনেক অজানা কথা। কুলটি থেকে সরাসরি টেলিফোনে মনীষা রায় জানালেন, ‘গতকাল ( শনিবার) রাত ১টায় মেয়ে ফোন করে জানাল, আমরা খুব খুশি হয়েছি। মেয়ের আমার লেখালিখির ঝোঁক ছিল। আমাদের অবজেকশন ছিল। আর ফিল্ম লাইন নিয়ে তেমন আইডিয়া ছিল না। দিল্লিতে গিয়ে মাস-কম পরে, ভালো ভালো চাকরি ছেড়ে দিল। আর আজকাল বিয়ে দিতে গেলেও ভালো চাকরি চাই। ওর বাবা চাইত মেয়ে একটা স্থায়ী চাকরি করুক। প্রায়ই বলত, ‘কী হবে এসব করে! সত্যজিৎ রায় হবে নাকি!’ মেয়ে বলেছিল, ‘অত বড় কিছু না হলেও নিজের মতো করে করতে কাজ করতে চাই।’ মেয়েটা আমার খুব লড়াই করেছে, অন্য শহরে গিয়ে খুব পরিশ্রম করেছে। এখন ওর বাবাও বলছে, ‘আগে এত কিছু বুঝতে পারিনি, বোকা বোকা প্রশ্ন করেছি’। অনেকদিন মেয়ে আমার বাড়ি ফেরেনি। ফোনে বলেছে, সব মিটলে বাড়ি আসবে। ও আমার হাতের মাটন ভাত খেতে খুব ভালোবাসে, বাড়ি এলে রাঁধব’।

    ভেনিস থেকে টেলিফোনে সংবাদ প্রতিদিন-কে অনুপর্ণা জানালেন , ‘ আমার খুব খুব ভালো লাগছে , কখনও ভাবিনি পুরুলিয়ার নারায়ণপুর গ্রাম থেকে ভেনিস পর্যন্ত পৌঁছতে পারব । এবং এই যাত্রাপথ একেবারেই সহজ ছিল না একজন মহিলা হিসেবে । আগামীদিনে আমি যেন আরও অনেক নারীর কথা , গল্প বলতে পারি । আমার ছবি দেখে যদি একজনও নবাগত মহিলা ফিল্মমেকার, ছবি তৈরি করার সাহস পান আমি নিজেকে ধন্য মনে করব ।’ অনুপর্ণা প্রতিদিন-কে এও জানালেন গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর দেখে তাঁর ছবি বানানোর কথা মনে হয় । পরিচালক জানান , ‘ ছবিটা দেখে অবসেসড হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি নিজেই একটা ইনষ্টিটিউশন । তিনি যে কত ভাবে সাহায্য করেছেন ভাবাই যায় না । অনেক মানুষের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, আমার সকল প্রযোজক , রঞ্জন সিং যে আমাকে অনুরাগের সঙ্গে আলাপ করায় , আমার ডিওপি দেবজিৎ সামন্ত, আমার কাস্ট, জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত এডিটর পরেশ কামদার , সেলুলয়েড ফিল্মস , কাকে ছেড়ে কার কথা বলব । এই জয় সিনেমার , এই জয় পুরুলিয়ার, বাংলার। এই জয় ইন্ডিফিল্মমেকারের ‘।

    সিনেমা নিয়ে বরাবরই প্যাশনেট ছিলেন অনুপর্ণা। পুরুলিয়ায় বড় হওয়া, কুলটি কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক হয়ে দিল্লিতে মাস কমিউনিকেশন পড়া, দিল্লির কলসেন্টারে কাজ করা, মুম্বইয়ে আইটি সেলস একজিকিউটিভের কাজ করার পরেও সিনেমা নিয়ে পড়ে থাকতেন। তাঁর প্রথম শর্ট ফিল্ম ‘রান টু দ্য রিভার’ও প্রশংসিত হয়। ‘সংস অফ ফরগটেন ট্রিজ’ ছবিতে দুজন অভিবাসী তরুণী মহিলার (অভিনয়ে নাজ শেখ ও সুমি বাঘেল) মুম্বই এসে নিজেদের নিত্যদিনের লড়াইয়ের মধ্যে, একে অপরকে খুঁজে পাওয়ার গল্প বলা হয়। ভেনিসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অনুপর্ণা বলছিলেন, ‘আমার স্কুলের বেস্ট ফ্রেন্ড ঝুমার ক্লাস এইটে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আর খোঁজ পাইনি। ওরা দলিত বলে বাবা আমাকে কথা বলতে দিতে চাইতেন না। ওর এইভাবে হারিয়ে যাওয়ায় আমাকে প্রভাবিত করেছিল। এই ছবির শিকড় সেখানেই। হ্যাঁ, প্রথমে তথ্যচিত্র করার ভাবনা ছিল, কিন্তু তারপর ফিকশন তৈরি করব ঠিক করলাম। ছবিতে নানা দিক আছে, কিন্তু এই ছবি সব কিছু ছাপিয়ে দুই তরুণীর নিজেদের ভিতর লুকোনো অনুভূতি খুঁজে পাওয়া এবং একে অপরের মধ্যে ভালোবাসা খুঁজে পাওয়ার কথা বলে।’ অনুপর্ণার এই জয় কেবল বাংলার নয় গোটা দেশের গর্ব। ভেনিসের অরিজন্তি বিভাগ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। ২৯ বছর বয়সি অনুপর্ণার ছবি প্রডিউস করেছে বিবাংশু রাই, রোমিল মোদি এবং রঞ্জন সিং। সেখান থেকেই পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপের সঙ্গে আলাপ। অনুরাগ কাশ্যপ অনুপর্ণার ছবিটি পরিবেশন করেছেন। অনুপর্ণার এই সাফল্যে সোশাল মিডিয়ায় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী, পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী, ঋত্বিক চক্রবর্তী, বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়, পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ।
  • Link to this news (প্রতিদিন)