রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন কড়া নাড়ছে দরজায়। পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে গত মে মাসেই জেলা স্তরে রদবদল করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। সাংগঠনিক জেলা ধরে ধরে ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করছেন দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এরই ফলশ্রুতিতে ব্লক সভাপতি পদে রদবদল শুরু হল তৃণমূলে। রবিবার তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তিন জেলা মালদা, উত্তর দিনাজপুর এবং দার্জিলিং জেলার ব্লক সভাপতি, শহর সভাপতি এবং আহ্বায়কদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
এই রদবদলের সূচকও যে পারফরম্যান্সের ভিত্তিতেই হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গোটা বছর ধরে কে কীভাবে কাজ করেছে, কতটা জনসংযোগ করতে পেরেছে সব কিছু বিচার করেই কোনও ব্যক্তিকে পদ দেওয়া বা কাউকে পদ থেকে সরানো হচ্ছে। এই সব তথ্য জোগাড় করার জন্যই ময়দানে নেমে পড়েছিলেন প্রতীক জৈনের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থা আইপ্যাকের প্রতিনিধিরা। রাজ্যের সব জেলায় ঘুরে সংস্থার প্রতিনিধিরা কাজ করেছিলেন। তৃণমূল স্তর থেকে তাঁরা তথ্য সংগ্রহ করে এনেছিলেন। শুধু দলীয় নেতানেত্রীদের সঙ্গে কথা বলাই নয়, বিরোধী দলের অনুগামীদের পাশাপাশি আমজনতার সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট কার্ড তৈরি করেছিলেন ওই প্রতিনিধিরা। সেই কার্ড পেশ করা হয়েছিল তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও দলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।
তবে শুধু আইপ্যাক নয়, সাংগঠনিক স্তরেও দলীয় নেতাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়াও শুরু করে দিয়েছিল। এবার তাঁদের একাধিক পারফরম্যান্স রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে বিধানসভা নির্বাচনের টিকিট দেওয়া হবে। তাই বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে তার ঝাড়াই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। সব দিক খতিয়ে দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে তার আগে পুরো প্রক্রিয়াটা আগেভাগেই সেরে রাখলেন অভিষেক। এক্ষেত্রে দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর পরামর্শও গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে অভিষেক যেমন রয়েছেন, ঠিক তেমনি তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে রাজ্য সভাপতি পদে থাকা সুব্রত বক্সীর সঙ্গে দলের প্রবীণ নেতাদের যথেষ্টই যোগাযোগ রয়েছে। এই দুইয়ের মেলবন্ধনের ফলশ্রুতিতে যে তথ্য উঠে আসবে, তা নিয়ে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আলোচনা করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এর পাশাপাশি তৃণমূলের প্রভাবশালী নেতামন্ত্রীদের পরামর্শও নিচ্ছে দল।
সব মিলিয়ে নবীন-প্রবীণের ভারসাম্যকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত তৃণমূল করছে নাকি তারুণ্যকে ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, সেই উত্তর পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে বিধানসভা নির্বাচনের জন্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হওয়া পর্যন্ত। ব্লকের পাশাপাশি যুব সভাপতি পদেও চল্লিশের উপর যাঁদের বয়স, তাঁদের সরিয়ে অন্যদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। কারণ ইতিমধ্যে এই নিয়ে সওয়াল করতে দেখা গিয়েছে দলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে। ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ কার্যকর করার ঝুঁকি না নিলেও পরবর্তী সময়ে এই পথে হাঁটার সম্ভাবনা থাকছে। তবে ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনে বিধায়কদের সংখ্যার নিরিখে বিধানসভায় বিজেপি যাতে এই রাজ্যে বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে না পারে, তার জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে তৃণমূল। আর সেই লক্ষ্যেই ব্লক সভাপতি পদে দলে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্য নেতাকেই বাছাই করা হচ্ছে।
তবে এবার আইপ্যাকের পারফরম্যান্সও স্ক্যানারের নিচে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে আইপ্যাকের প্রতিনিধিদের কাজ খতিয়ে দেখছেন। বিধানসভা নির্বাচনের আগে কোনও রকম ঝুঁকি নিতে চান না দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড। তিনি জানেন, নির্বাচনের আগে একটা কোনও ভুল পদক্ষেপ দলের উপরে বড়সড় প্রভাব পড়তে পারে। সেই কারণে আইপ্যাকের সমীক্ষাকেও ক্রসচেক করে নিতে চাইছেন স্বয়ং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ কোথাও যেন কোনও অনিয়ম না হয়, যোগ্য নেতারা যাতে পদপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত না হন এবং অকারণে কাউকে যেন পদ খোয়াতে না হয়। উল্লেখ্য, অতীতে তৃণমূলের বেশ কয়েকজন প্রথম সারির নেতা আইপ্যাক নিয়ে তাঁদের ক্ষোভের কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন।
দলের অন্দরে এই নিয়ে যথেষ্ট কানাঘুষাে রয়েছে। যদিও বর্তমান সময়ে এই নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও শাসকনেতা অভিযোগ করেননি। উল্লেখ্য, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে রাজ্য রাজনীতিতে প্রবেশ করা এই সংস্থার প্রতি একটা সময়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীও। কিন্তু পরে অবশ্য তিনি প্রকাশ্যে আইপ্যাক সম্পর্কে কোনও উল্টোপাল্টা কথা বলতে বারণ করেছিলেন দলীয় নেতৃত্বকে। বিধানসভা নির্বাচনের আগে দলের নেতানেত্রীরা যাতে আইপ্যাকের সঙ্গে সমন্বয় বজায় রেখে কাজ করেন সেই বার্তাই দিয়েছেন মমতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আইপ্যাক নিয়ে পুরোপুরি অসন্তোষ এখনও কাটেনি। সে কারণেই হয়তো আইপ্যাকের রিপোর্টও খতিয়ে দেখছেন অভিষেক। লক্ষ্য একটাই, সঠিক তথ্য যেন তৃণমূল স্তর থেকে উঠে আসে।
জেলায় জেলায় আইপ্যাকের প্রতিনিধিদের সপক্ষে টানার জন্য তৃণমূলের নেতানেত্রীদের মধ্যে রেষারেষি শুরু হয়ে গিয়েছে। কী করলে এই প্রতিনিধিদের মন পাওয়া যায়, তার জন্য চেষ্টার ত্রুটিই রাখছেন না। শাসক নেতানেত্রীদের একাংশ। এই নিয়ে অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বেশ কয়েকটি জেলায়। এধরনের তথ্য অভিষেকের কাছে এসে পৌঁছেছে। ফলে তৃণমূল নেতাদের অনেকে মনে করছেন, শীর্ষ স্তরে সঠিক রিপোর্ট আদৌ কি পৌঁছনো সম্ভব? এই সবকিছুর মুশকিল আসানের জন্য বেশ কয়েকটি রিপোর্টকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজস্ব সোর্সকে ব্যবহার করছেন।
এদিকে ‘সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী’কে ফোন করে তৃণমূলের অনেক নেতার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ করেছিলেন সাধারণ মানুষ। সেই সকল নেতারা যে বিধায়কের অধীনে কাজ করেন তাঁদের সঙ্গে গিয়েও কথা বলছেন আইপ্যাকের প্রতিনিধিরা। সব কিছু খতিয়ে দেখার পর প্রাথমিকভাবে সেই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তা শীর্ষ নেতৃত্বের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার বিধায়ককেও জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা নেতাদের পদপ্রাপ্তি হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশ কমছে। একইসঙ্গে অভিযুক্ত নেতানেত্রীদের পথ থেকে সরিয়েও দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, ৪০ বছরের উপরের একাধিক যুব নেতাকে আইপ্যাকের কর্তারা ফোন করে সতর্ক করে দিচ্ছেন, যুব তৃণমূলের পদে এবার হয়তো অন্য কাউকে আনা হতে পারে। বিশেষ করে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকার নেতাদের ক্ষেত্রে এই কাজ করেছে আইপ্যাক। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট পদে এলাকার অন্য কোনও নেতাকে বসানো যায় কি না তা–ও ওই ব্যক্তির কাছ থেকেই জেনে নেওয়া হচ্ছে।
এই সব অভিযোগ পেয়ে এবার আইপ্যাককেও নজরবন্দি করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আইপ্যাকের রিপোর্ট কতটা যুক্তিযুক্ত তা ক্রসচেক করে দেখা হচ্ছে। শুধু সংস্থার রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই রদবদলের সিদ্ধান্ত নয় বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অভিষেক ও তাঁর টিম।
প্রসঙ্গত, দুর্গাপুজোর পরে বাংলা ও বাঙালি হেনস্থা ইস্যুতে ফের জোরদার আন্দোলনে নামতে চলেছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। পাশাপাশি রয়েছে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বাংলাকে বঞ্চনার বিষয়টিও। এই দুই ইস্যুতে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সুর চড়াবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল। আন্দোলনকে বুথ স্তর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়াই হবে তৃণমূলের অন্যতম লক্ষ্য। একই সঙ্গে চলবে জনসংযোগের কাজ। ‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান’, ‘দুয়ারে সরকার’ ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক প্রকল্পকে হাতিয়ার করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন সব স্তরের জনপ্রতিনিধিরা। এই সব কাজ তদারকি করছে আইপ্যাক। দলের নেতাদের পারফরম্যান্স বিচার করে রিপোর্ট তৈরি করছেন সংস্থার প্রতিনিধিরা।
গত বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী প্রার্থী ছাড়া এলাকায় অন্য কোনও জনপ্রিয় নেতা রয়েছেন কি না, তাঁদের সমর্থন কত ইত্যাদি তথ্যও জোগাড় করছেন আইপ্যাকের প্রতিনিধিরা। পাশাপাশি পুলিশ–প্রশাসনের কাছ থেকে তৃণমূল নেতাদের রিপোর্ট কার্ডও নিতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্ক বুঝতে ও নেতাদের ভাবমূর্তি জানতে পুলিশ–প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া রিপোর্টটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচরাচর নেতাদের পারফরম্যান্সের সঠিক রিপোর্ট বের করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। এজন্য আইপ্যাককে অনেক সময় বাধার মুখে পড়তে হয়। আবার দলের অনেক নেতাদের অভিযোগ, সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে না। সেই কারণে তাঁদের পারফরম্যান্স রিপোর্টও প্রভাবিত হচ্ছে।