• রাজবংশী বধূর বেশেই উমা আসেন তিস্তাপাড়ে, আড়াইপাক লাঙল ঘোরার পরই হয় বিসর্জন
    বর্তমান | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ব্রতীন দাস, আমগুড়ি: সময় বদলেছে। কিন্তু বদলায়নি এই পুজোর রীতি কিংবা প্রতিমার গড়ন। আজও রাজবংশী বধূর বেশে উমা আসেন তিস্তাপাড়ে ময়নাগুড়ির আমগুড়িতে বসুনিয়া পরিবারে। ২১৫ বছরের প্রাচীন এটিই ডুয়ার্সের প্রথম পুজো! আর পাঁচটা দুর্গা প্রতিমার চেয়ে এখানকার দেবীমূর্তি একেবারে আলাদা। এখানে দশভুজার মুখে মঙ্গোলীয় ছাপ। ঠোঁটের কোণে চিকন হাসি। হৈমবতীর চোখ, নাক কিংবা মুখের আদলে স্পষ্ট, তিনি এলাকারই চাষির ঘরের মেয়ে। মা দুর্গা এখানে দেবী ঠাকুরানি নামে পরিচিত। রাজকীয় সাজ নেই। নেই অলঙ্কারের বাহুল্য। পরনে তিস্তাপাড়ের মহিলাদের সাবেকি পোশাক ফোতা। কেউ বলেন পাটানি। গোড়ালির উপরে কাপড়, ঠিক যেমনভাবে পোশাক পরেন রাজবংশী বধূরা। 

    বসুনিয়া পরিবারের পুজো হলেও এটি এখন গোটা আমগুড়ির পুজো। দেবীর আরাধনার আগে গ্রামপুজোয় মাতেন বাসিন্দারা। মহালয়া থেকে শুরু হয় ওই পুজো। এটি আসলে শিবের আরাধনা। নবমীতে ঘরে ঘরে গোটা ফল দিয়ে হয় মাত্রা (মাতৃ) পুজো। আর দশমীতে যাত্রাপুজো। ওই পুজো শেষে কৃষকরা জমিতে লাঙল দিয়ে কর্ষণ করেন। সেই জমিতেই শুরু হয় শীতের শস্য চাষ। গোটা গ্রামে আড়াই পাক লাঙল না ঘোরা পর্যন্ত বিসর্জন হয় না দেবীর। একসময় এই পুজোয় মোষ বলি হতো। এখনও পাঁঠা বলি হয়। দশমীতে দেবীকে খেতে দেওয়া হয় পান্তাভাত, শাপলার ঝোল আর কচুশাক।  

    সালটা ১৮১০। কোচবিহার রাজার দেওয়ানির কাজ দেখাশোনা করতেন ধনবর বসুনিয়া। কোনও কারণে সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে তৎকালীন চাপগড় পরগনার অধীন আমগুড়িতে বসতি গড়েন তিনি। তখন গোটা এলাকা শ্বাপদসঙ্কুল। হাতি-বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেতে দেবীর পুজো শুরু করেন ধনবর। রংপুর থেকে প্রতিমা নিয়ে আসেন। ঢাকিও আসে সেখান থেকে। কোচবিহারের দেবীবাড়ির দেবীর মতোই এখানকার মা দুর্গা রক্তিম বর্ণের। 

    একটা সময় বসুনিয়াদের জোতদারি ছিল। এখন আর তা নেই। সময়ের সঙ্গে বদলে গিয়েছে এলাকার পরিবেশ। মেঠোপথ এখন ঝাঁ চকচকে পিচের রাস্তা। গোরু কিংবা মোষের গাড়ি উধাও। গোবর লেপা মাটির দেওয়াল আর খড়ের ছাউনির ঘরও নেই। সবার মাথার উপর পাকা ছাদ। কিন্তু আজও বদলায়নি এই পুজো। বসুনিয়া পরিবারের কড়া নির্দেশ, মায়ের মুখের আদলের যেন কোনও বদল না হয়। বছরের পর বছর ধরে তা অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্পী রায় পরিবার। বেশকিছু বছর ধরে এখানকার প্রতিমা গড়ছেন শ্রীমন্ত রায়। আগে তাঁর বাবা-ঠাকুরদা বসুনিয়া পরিবারের মাতৃমূর্তি গড়েছেন। 

    শ্রীমন্ত বলেন, এখানকার মাতৃমুখ ছাঁচে হয় না। যা করতে হয় সবটাই হাতে। মায়ের পোশাকও ভিন্ন। দুর্গার সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতীর পরনে থাকে পাটানি। কার্তিক-গণেশের পরনে ধুতি আর হাতাওয়ালা গেঞ্জি। পরিবারের ষষ্ঠ পুরুষ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুনীল বসুনিয়া বলেন, দেবী রূপে নন, গাঁয়ের মেয়ে-বধূ হিসেবে এখানে মা দুর্গা আসেন। সেভাবেই যত্নআত্তি পান। আমাদের দশভুজার মুখে থাকে মঙ্গোলীয় ছাপ। যুগ যুগ ধরে এই রূপেই পুজো হয়ে আসছে। বাসিন্দাদের পাশাপাশি পর্যটকরাও ভিড় জমান দেবী ঠাকুরানির পুজোয়। আসেন গবেষকরাও।  ফাইল চিত্র।
  • Link to this news (বর্তমান)