• জট খুলে পাভলভ থেকে ইউরোপে সুজাতা
    আনন্দবাজার | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • কলকাতা তাঁর চেনা শহর। কিন্তু, এখানে ফিরে এমন দুর্বিপাকে পড়তে হবে, ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি বিদেশি নাগরিক সুজাতা (নাম পরিবর্তিত)। আবার, চেনা-অচেনা নতুন বন্ধুদের হাত ধরেই যে এই সঙ্কট থেকে মুক্তি আসবে, সেটাও ছিল কল্পনাতীত। পাভলভ মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, ইউরোপের একটি দেশের নাগরিক এক বাঙালিনির ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে।

    মানসিক সমস্যাকে আজও এক ধরনের কলঙ্ক বলে দেখেন অনেকে। কিন্তু সমস‍্যাটা বোঝাতে পারলে মানসিক রোগের শিকার মানুষদের প্রতি সহৃদয়তাও অসম্ভব নয়। সেটাই দেখা গিয়েছে সুজাতার ঘটনায়। মা অসুস্থ বলে গত বছর পুজোর আগে তাঁর এখনকার দেশ থেকে কলকাতায় ফিরেছিলেন উত্তর-ত্রিশের ওই মহিলা। সুজাতা একদা শারীরতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে। বাবার অধ‍্যাপনার সূত্রে ইউরোপের একটি দেশে গিয়ে সেখানকার নাগরিক হন। ইউরোপ, আমেরিকায় কিছু দিন স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চাকরিও করেছেন সুজাতা।

    পাভলভ সূত্রে জানা গিয়েছে, ইউরোপবাসিনী ওই মহিলাকে মানসিক সমস‍্যায় কিছু ওষুধ খেতে হত আগেও। কিন্তু পরে তাতে কিছু অনিয়ম হয়। এ শহরে ফিরে প্রথমে বারুইপুরের কাছে মায়ের বৃদ্ধাবাসে থাকছিলেন সুজাতা। সেখানে কিছু মনোমালিন‍্য হওয়ায় চলে আসেন। পরের ঠিকানা হয় শিয়ালদহ স্টেশনের ওয়েটিং রুম! সেখানে লটবহর সুদ্ধ তিনি থাকছিলেন। ইতিমধ্যে মা মারা যান সুজাতার। এবং তার পরে হঠাৎ গাড়ির ধাক্কায় আহত হয়েই নতুন সমস্যার সূত্রপাত। প্রথমে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল এবং পরে মানসিক সমস্যার উপসর্গের জেরে পাভলভ মানসিক হাসপাতালে সুজাতাকে ভর্তি করা হয়। ইতিমধ্যে তাঁর ভারতে থাকার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছিল। হাসপাতালে ভর্তির সময়ে তাঁর দেশের দূতাবাসের কলকাতার আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগও করেন সুজাতা। পাভলভে ভর্তির পরেও তাঁরা সুজাতার বিষয়ে সজাগ ছিলেন।

    পাভলভে মানসিক রোগীদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অঞ্জলি এর পরে সুজাতার পরিচর্যা ও পুনর্বাসনের বিষয়ে তৎপর হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, ইউরোপে সুজাতার নিজের লোক তাঁর দিদি। যে দিদির থেকে বেশ কয়েক বছর তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। সুজাতার সঙ্গে দেশে ফেরার টাকাও ছিল না। তা ছাড়া, ভারতে থাকার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও এখানে থেকে যাওয়ায় তাঁর মোটা টাকা জরিমানা ধার্য করে আঞ্চলিক বিদেশি নিবন্ধিকরণ দফতর (এফআরআরও)।

    মানসিক রোগীদের অধিকার রক্ষা কর্মী তথা অঞ্জলির কর্ণধার রত্নাবলী রায় বলেন, “এতগুলো বাধা পেরোনো সহজ ছিল না। কিন্তু হাসপাতাল থেকে শুরু করে আমাদের কর্মী, দূতাবাসের আধিকারিক— সবাই একজোট হয়ে চেষ্টা করেন।” এফআরআরও-কে সুজাতার পরিস্থিতি বোঝান অঞ্জলির আধিকারিক অনিন্দিতা চক্রবর্তী। দরকার মতো হাসপাতালের ডাক্তারদের নথি এনে দেন। সুজাতাকেও দেখা করাতে নিয়ে যান। দূতাবাসের যোগসূত্রে সুজাতার দিদি তাঁর বোনের ফেরার টাকাটা দিলে তড়িঘড়ি টিকিট কাটা হয়। অঞ্জলির উদ‍্যোগে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সুজাতার জিনিসপত্র, প্রিয় গিটারও উদ্ধার হয়। দূতাবাসের কর্মীরা সুজাতাকে বোঝান, কী ভাবে কলকাতা থেকে উড়ান বদলে গন্তব‍্যে যেতে হবে।

    এখন ইউরোপে স্বাভাবিক জীবনের পথে এগোচ্ছেন সুজাতা। বড় দুর্বিপাকে নাজেহাল হলেও তা দিদির সঙ্গে ফের মিলিয়ে দিয়েছে তাঁকে। অঞ্জলির আধিকারিক শুক্লা দাস বড়ুয়াকে ইমেলে ধন‍্যবাদ জানিয়ে সুজাতা বলেছেন, নিয়মিত ওষুধ খেয়ে স্থানীয় চিকিৎসা কেন্দ্রের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখছেন। রত্নাবলীর কথায়, “সমাজের নানা স্তরের প্রতিনিধিরা পাশে না থাকলে সুজাতার জীবনে জট খুলত না।”
  • Link to this news (আনন্দবাজার)