• ‘ছাত্রছাত্রীদের মুখগুলো হাল ছাড়তে দেয় না’
    আনন্দবাজার | ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ২০০৯-এর শিক্ষার অধিকার আইন বলছে, প্রাথমিকে ৩০ জন পড়ুয়াপিছু এক জন শিক্ষক থাকা বাধ্যতামূলক। তবে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের হারাবতী গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে তা আকাশকুসুম কল্পনা। শিশু শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ৫২ জন পড়ুয়ার জন্য রয়েছেন মাত্র এক শিক্ষক। জেলার ৩৭০টির বেশি স্কুল এক জন শিক্ষক নিয়ে বা কোনও ক্ষেত্রে শিক্ষকহীন অবস্থায় ধুঁকছে।

    বিষ্ণুপুর শহর লাগোয়া মড়ার পঞ্চায়েতের এই স্কুলের পড়ুয়ারা মূলত প্রথম প্রজন্মের। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের ছেলেমেয়েদের কাছে পড়াশোনার সঙ্গে মিড-ডে মিলও গুরুত্বপূর্ণ। দু’দিক সামলাতে হিমশিম খান স্কুলের একমাত্র শিক্ষক সমীর বিশ্বাস। ১৫ কিলোমিটার দূরে বিষ্ণুপুর শহরে তাঁর বাড়ি। জঙ্গলপথ পেরিয়ে কিছুটা আগেই রোজ স্কুলে আসেন। মিডডে মিলের আনাজপাতি কিনে, শ্রেণিকক্ষের টুকটাক সাফাই সেরে তবে পড়ানোয় মন দিতে পারেন।

    সমীর জানাচ্ছিলেন, পড়ুয়াদের দু’টি শ্রেণিকক্ষে বসানো হয়। এক ঘরে ছাত্রছাত্রীদের লেখালিখির কাজ দিয়ে অন্য ঘরে যান পড়া ধরতে। এরই ফাঁকে আসেন মিড-ডে মিল রান্নার লোকজন। তাঁদের মুদির দোকানে পাঠানো, উপস্থিত পড়ুয়ার সংখ্যা অনুযায়ী চাল মেপে দেওয়ার দায়িত্বও তাঁর ঘাড়ে। বিরতিতে পড়ুয়ারা যাতে বাইরে বেরিয়ে না যায়, স্কুলের মূল দরজায় কড়া নজরও রাখতে হয়। সমীর বলেন, “স্কুল ছুটির পরেও কাজ শেষ হয় না। প্রায়ই ছুটির পরে আবার স্কুল পরিদর্শকের দফতরে যেতে হয়। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা গড়ায়।”

    বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের ব্লকগুলিতে অনেক স্কুলে ছবিটা একই। এই পরিস্থিতির জন্য শিক্ষক নিয়োগ না হওয়া এবং অনৈতিক পদ্ধতিতে শিক্ষকদের গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে বদলির প্রবণতাকে দুষছেন এবিপিটিএ-র জেলা সম্পাদক বিমান পাত্র। তাঁর মতে, “ফল ভুগছেন কিছু শিক্ষক আর পড়ুয়ারা। একা হাতে স্কুল সামলানোয় প্রভাব পড়ছে পঠনপাঠনে।”

    যদিও অভিভাবকদের তেমন অভিযোগ নেই। বরং শ্রাবন্তী রায়, উত্তম রায়েরা বলেন, “রোদ, জল, ঝড়— স্যরকে আটকাতে পারে না। ওঁর জন্যই ছেলেমেয়েগুলো পড়তে পারছে। অন্তত এক জন শিক্ষক এলে সুরাহা হয়।” চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া জয়দীপ রায়, পিয়া রায়েরা বলে, “স্যরের অনেক চাপ। তাই ওঁর কথা শুনে চলি।”

    বিষয়টি জেলা স্কুলশিক্ষা দফতরের নজরে রয়েছে বলে দাবি পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির বাঁকুড়া সাংগঠনিক জেলা সভানেত্রী স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান শ্যামল সাঁতরাও বলেন, “হারাবতী প্রাথমিক স্কুলের বিষয়টি দেখা হবে।” আর সমীর বলেন, “কাজের চাপে নাজেহাল হয়ে যাই। তবে যখনই হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবি, ছাত্রছাত্রীদের মুখগুলো মনে পড়ে যায়।”
  • Link to this news (আনন্দবাজার)