• ক্ষণে ক্ষণে ফোনে মৃত্যুসংবাদ, প্রবল উৎকণ্ঠায় শহরের নেপালিরা
    আনন্দবাজার | ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • কারও কাছে ফোন আসছে, বাড়ির সামনেই স্কুল, অফিস, আদালত জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেউ নিকটাত্মীয়ের ফোন পাচ্ছেন, বাড়ি থেকে বেরোনো যাচ্ছে না বলে। মজুত করে রাখা খাবার কত দিন চলবে, এর পরে কী হবে, কিছুই বুঝতে পারছেন না তাঁরা। অনেকেই খবর পাঠাচ্ছেন পরিচিতের মৃত্যুর! কারও কাছে আবার সেটুকুরও সুযোগ নেই, ফোনের নেটওয়ার্ক ঠিকঠাক কাজ করছে না বলে। সমাজমাধ্যমে যে যোগাযোগ করে খবর নেবেন, সেই সুযোগও নেই!

    নিজেদের দেশ নেপালের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যে এখন এমনই উৎকণ্ঠায় সময় কাটছে কলকাতায় থাকা নেপালিদের। তাঁরা বলছেন, ‘‘দুর্নীতি, অত্যাচার, ব্যাভিচার দীর্ঘদিন চলেছে। সে সব থেকে এটাই হয়তো মুক্তির শেষ পথ। কিন্তু সে পথে বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের প্রাণনাশের এই তাণ্ডব এ বার বন্ধ হোক।’’

    কলকাতার যে সমস্ত জায়গায় নেপালিদের বাস, তার মধ্যে অন্যতম বেহালার নতুন হাটের বিবেকানন্দ পার্ক। সেখানে মঙ্গলবার দুপুরে জড়ো হয়েছিলেন নেপালি সম্প্রদায়ের অনেকেই। তাঁরা মোমবাতি জ্বালিয়ে শান্তির বার্তা দিয়েছেন। যখন তাঁদের সঙ্গে কথা হচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই সংবাদমাধ্যম দেখাচ্ছে, নেপালের উপ-প্রধানমন্ত্রীর আক্রান্ত হওয়ার ভিডিয়ো। তাণ্ডব চালানো মানুষের মারমুখী হয়ে সরকারি সব ভবন ধ্বংস করার ছবি। টিভিতে যা দেখতে দেখতেই প্রেমকুমার লামা বললেন, ‘‘জনকপুরে আমাদের বাড়ি। সেখানেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফল কী হবে, ভেবে পাচ্ছি না।’’ এর পরে তাঁর মন্তব্য, ‘‘দেশে চাকরি নেই। আমাদের বাইরে চলে আসতে হয়। তাই আমিও এসেছিলাম। কিন্তু এখন যদি অশান্তির জন্য অন্য দেশ আমাদের আর নিতে না চায়, ছেলে-মেয়েগুলো যাবে কোথায়!’’

    একই পরিস্থিতি রেণুকুমার শ্রেষ্ঠার বাড়িতে। কাঠমান্ডুর ভক্তপুরে তাঁদের আদি বাড়ি। ফোন ধরে কেঁদে চলেছেন তিনি। নিজস্ব ভাষায় কথা বলে ফোন রেখে রেণু বললেন, ‘‘আমাদের বাড়ির সামনেই গুলি চলছে। দু’জন আমাদের পাড়ারই মারা গিয়েছেন। মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা সামনে আসছে না। এর পরে কী হবে, জানি না।’’ অস্ফুটে এর পরে বললেন, ‘‘পুজোয় আমার আত্মীয়দের কলকাতায় আসার কথা ছিল। এখন তো প্রাণ বাঁচাতে চাইলেও আসতে পারবে না। খবর পেলাম, ভারতের সঙ্গে নেপালের সমস্ত সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’’

    একই রকম উৎকণ্ঠা যাদবপুরের পড়ুয়া রোহনকুমার প্রধানের। তিনি আবার বললেন, ‘‘আমার বাবা-মা বয়স্ক। বাড়িতে আটকে পড়েছেন। দ্রুত ওঁদের কাছে ফেরার চেষ্টা করছি। তবে, এই আন্দোলনকে সমাজমাধ্যম ব্যবহার করতে না-পারার ক্ষোভ হিসাবে দেখানো হচ্ছে বহু জায়গায়। কিন্তু এটা আদতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ লড়াই।’’ নয়নবাহাদুর মুখিয়া নামে আর এক ব্যক্তির দাবি, ‘‘দেশে চাকরি নেই বলেই তো আমাদের বাইরে আসতে হয়েছে। বাইরে থাকা ছেলেমেয়েরা পরিবারের সঙ্গে সমাজমাধ্যমেই যোগাযোগ করেন। সবটা এ ভাবে বন্ধ করা যায়? যেমন খুশি সরকার চালাতে গিয়ে বাক্‌স্বাধীনতায় হানা দেওয়া হয়েছে।’’

    বিবেকানন্দ পার্কেই কাঠমান্ডুর পশুপতিনাথ মন্দিরের আদলে মন্দির তৈরি হচ্ছে। তারই নির্মীয়মাণ চাতালে দাঁড়িয়ে নেপালে থাকা সেখানকার বাসিন্দাদের দশ দফা দাবি পড়ে শুনিয়ে কলকাতার ‘সংযুক্ত নেপালি কেন্দ্রীয় সেবা সঙ্ঘ’-এর সভাপতি চন্দ্রবাহাদুর সাংদান বললেন, ‘‘ভারতই এখন আমাদের দেশ। কিন্তু আমাদের মাতৃভূমি নেপাল। মাতৃভূমি জ্বলছে। দ্রুত শান্তি আর উন্নয়ন ফিরুক।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)