গোলরক্ষা তাঁর কাছে দেশরক্ষার সমতুল। তাই ফুটবলের মাঠ জীবনযুদ্ধের ক্ষেত্র হলেও জীবনাদর্শে তাঁর আরাধ্য এক মহান বিপ্লবী— ভগৎ সিংহ। চিন্তন এমন উঁচু তারে বাঁধা বলেই কি তিনি সোনালি অতীত ফেরানোর স্বপ্ন দেখানো ভারতীয় ফুটবল দলের অন্যতম কারিগর হয়ে উঠতে পেরেছেন? মঙ্গলবার দুপুরে তাজিকিস্তানের হিসোর থেকে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে মন খুললেন গুরপ্রীত সিংহ সাঁধু।
প্রশ্ন: ফিফা ক্রমতালিকায় ভারতের চেয়ে ৫৪ ধাপ এগিয়ে থাকা ওমানকে হারিয়ে কাফা নেশনস কাপে ব্রোঞ্জ জয় কি আপনার জীবনের সেরা প্রাপ্তি?
গুরপ্রীত সিংহ সাঁধু: অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। ফুটবলার-জীবনে সেরা প্রাপ্তির তালিকায় প্রথম পাঁচেই থাকবে এই ম্যাচ। কারণ, এই সাফল্য বিদেশের মাটিতে এসেছে। তার উপরে আমি অধিনায়ক ছিলাম ওমান ম্যাচে। ভারতীয় দলে ১৫ বছর ধরে খেলছি। কিন্তু এর আগে ওমানকে কখনওই হারাতে পারিনি। অবশেষে অপেক্ষার অবসান হল।
প্র: এএফসি এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছিলেন। কাফা নেশনস কাপকে কি আপনারও প্রত্যাবর্তনেরমঞ্চ বলবেন?
গুরপ্রীত: আমার ফুটবল জীবনের সব চেয়ে কঠিন সময় কাটিয়েছিলাম তখন। তবে হতাশা এলেও ভেঙে পড়িনি। বিশ্বাস ছিল, ঘুরে দাঁড়াব। একই সঙ্গে জানতাম, আমাকে একাই লড়াই করতে হবে। যদি আমি নিষ্ঠার সঙ্গে পরিশ্রম করে যেতে পারি, ঠিক ঘুরে দাঁড়াতে পারব।
প্র: প্রত্যাবর্তনের লড়াই কতটাকঠিন ছিল?
গুরপ্রীত: প্রচণ্ড, তাই মরসুম শেষ হওয়ার পরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এ বার বিশ্রাম নেব না। আমার সতীর্থেরা যখন সকলেই ছুটি উপভোগ করছিল, আমি তখন চলে গিয়েছিলাম নরওয়ের স্টাবেক এফসি-তে। পুরনো ক্লাবে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলাম অনুশীলনে। তার পরে দেশে ফিরে বেঙ্গালুরু এফসি-র যুব দলের সঙ্গেও অনুশীলন করেছিলাম। আমি মনে করি, কাজ এখনও শেষ হয়নি। সবে তো মাত্র একটা ধাপ পেরিয়েছি। সামনে আরও কঠিন লড়াইঅপেক্ষা করছে।
প্র: কঠিন সময়ে নিজেকে কী ভাবে উদ্বুদ্ধ করেন? বাবা-মা পুলিশ বলেই কি মানসিক ভাবে এতটা শক্তিশালী?
গুরপ্রীত: অবশ্যই, বাবা ও মায়ের প্রভাব তো রয়েছেই। তা ছাড়া জীবন থেকেও শিক্ষা নিই। তবে আমাকে সব চেয়ে অনুপ্রাণিত করেন ভগৎ সিংহ। তিনিই আমার জীবনের আদর্শ।
প্র: আপনার আদর্শ কোনওগোলরক্ষক নন?
গুরপ্রীত: না, আমার আদর্শ ভগৎ সিংহ। সতীর্থকে লেখা তাঁর একটি চিঠি পড়ে আমার দর্শনই বদলে গিয়েছে। শহিদ ভগৎ সিংহ লিখেছিলেন, ‘‘গোটা বিশ্ব তোমার বিরুদ্ধে চলে গেলেও লড়াই করতে ভুলে যেয়ো না।’’ আমার জীবনেরও মন্ত্র এটা। যখনই ভগৎ সিংহের জীবনী পড়ি, মনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। একটা মানুষ দেশের জন্য শুধু আত্মত্যাগই করেননি, নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। ভারতীয় দলের জার্সি যখনই পরি, তখনই মনে মনে স্মরণ করি ভগৎ সিংহকে। মুহূর্তের মধ্যে মনোবল কয়েক গুণ বেড়ে যায়। নিজেকে মনে হয় এক জন যোদ্ধা। তাই প্রতিপক্ষ যত শক্তিশালী হোক না কেন, পরোয়া করি না।
প্র: টাইব্রেকারের সময়েও কী আপনার রক্তচাপ বেড়ে যায় না?
গুরপ্রীত: না, টাইব্রেকারের সময় গোলরক্ষকদের কাজ হল মাথা ঠান্ডা রেখে বিপক্ষের যে-ফুটবলার শট নিতে আসছে তার উপরে চাপ সৃষ্টি করা।
প্র: টাইব্রেকারের সময় আপনার রণকৌশল কী?
গুরপ্রীত (হাসি): এই ব্যাপারটা গোপনই থাক। শুধু এটুকু বলতে পারি, শট নিতে আসা বিপক্ষের ফুটবলারের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। প্রভাবিত করার চেষ্টা করি, আমার যে-দিকটা শক্তিশালী, সেই দিকেই বল মারতে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলব না।
প্র: টাইব্রেকারে ওমানের জামিল সালেমের শট বাঁচিয়ে ভারতের জয়ের নায়ক আপনি। কিন্তু পরের ম্যাচে একটা গোল খেলে আপনাকেই হয়তো কাঠগড়ায় তোলা হবে। বছরের পর বছর ধরে এই মানসিক চাপ কীভাবে সামলান?
গুরপ্রীত: গোলকিপিং হল ‘থ্যাঙ্কলেস জব’। আপনি হয়তো পুরো ম্যাচে একাধিক অবধারিত গোল বাঁচালেন। কিন্তু তার পরে একটা গোল খেলেই খলনায়ক হয়ে যাবেন। সেই গোল যদি অন্যের ভুলে হয়, তা হলেও আপনাকে কাঠগড়ায় তোলা হবে। গোলরক্ষকদের মেনে নিতে হবে, এটাই জীবন। যারা যত দ্রুত এই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে, তত চাপমুক্ত হয়ে খেলতে পারবে। সকলের প্রত্যাশা কখনওই পূরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু মাঠে নেমে সব সময় সেরাটা দিতেই হবে। মনে রাখতে হবে, সমর্থকেরা টাকা খরচ করে ম্যাচ দেখতে আসেন। ফলে প্রিয় দল হারলে হতাশ হয়ে পড়াই স্বাভাবিক। আর গোলরক্ষক যে-হেতু শেষ প্রহরী, তার উপরেই রাগ বেশি হয় সমর্থকদের।
প্র: কাফা নেশনস কাপের ঠিক আগেই জাতীয় দলের দায়িত্ব নেন খালিদ জামিল। এই প্রতিযোগিতার জন্য মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট এক জন ফুটবলারও ছাড়েনি। তাজিকিস্তানের হিসোর রওনা হওয়ার আগে কি এক মুহূর্তের জন্য ভাবতে পেরেছিলেন, তৃতীয় স্থানে শেষ করতে পারবে ভারতীয় দল?
গুরপ্রীত: অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু প্রথম দিন থেকেই আমাদের লক্ষ্য ছিল ফাইনালে ওঠা। কাফা নেশনস কাপের প্রতিপক্ষ বা আমাদের দলে কারা রয়েছে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তাই করিনি। প্রত্যেকের মানসিকতা ছিল— প্রতিপক্ষ যত শক্তিশালীই হোক, আমরা ভয় পাব না। জেতার জন্যই ঝাঁপাব। তাজিকিস্তান রওনা হওয়ার আগে ফাইনালে খেলার যে-লক্ষ্য আমরা স্থির করেছিলাম, তা যদিও পূরণ করতে পারিনি। তাই ব্রোঞ্জ জিতলেও এই আক্ষেপ সহজে দূর হবে না।
প্র: বব হাউটন, স্টিভন কনস্ট্যান্টাইন থেকে ইগর স্তিমাচ— জাতীয় দলে দীর্ঘ দিন বিদেশি কোচের অধীনে খেলেছেন। এ বার কোচ এক জন ভারতীয়। কোনও পার্থক্যচোখে পড়ছে?
গুরপ্রীত: আমি যাঁদের কোচিংয়ে খেলেছি, তাঁরা প্রত্যেকেই অসাধারণ। খালিদ স্যরও প্রচণ্ড পরিশ্রমী এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ। গভীর ভাবে চিন্তাভাবনা করেন ম্যাচ নিয়ে। মাঠে ফুটবলারদের কাছ থেকে তিনি কী চান, খুব সহজ ভাবে বুঝিয়ে দেন। এ ভাবে সব কিছু মসৃণ ভাবে যদি চলে, ভবিষ্যতে ভারতীয় দল আরওউন্নতি করবে।
প্র: শৃঙ্খলার ব্যাপারে খালিদ কি স্টিভনের চেয়েও বেশি কড়া?
গুরপ্রীত (হাসি): খালিদ স্যরকেই এই প্রশ্নটা করুন।
প্র: শিলংয়ে এএফসি এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বের দ্বৈরথে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গোলরক্ষক বিশাল কেথের ভুলে ডুবতে বসেছিল ভারতীয় দল। গোলশূন্য অবস্থায় ম্যাচ শেষ হওয়ার পরেই সমাজমাধ্যমে আপনার লেখা, ‘পার্থক্য আছে’ নিয়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার হতাশা থেকেই কি এই মন্তব্য করেছিলেন?
গুরপ্রীত: কয়েক সপ্তাহ কঠোর পরিশ্রমের পরে নিজের খেলায় যে-ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলাম, সেটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। বিশ্বাস করুন, কাউকে আক্রমণ করা আমার লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু সমাজমাধ্যমে সম্পূর্ণ অন্য ব্যাখ্যা শুরু হয়ে যায়। বিতর্ক থামাতে শেষ পর্যন্ত আমি সেই পোস্ট মুছে ফেলেছিলাম। বিতর্ক তাতেওঅবশ্য থামেনি।
প্র: ইস্টবেঙ্গল থেকেই আপনার উত্থান। লাল-হলুদ জনতার আবেগ ও উন্মাদনা কি মনে পড়ে?
গুরপ্রীত: অবশ্যই, ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলতে কলকাতায় না-গেলে এই জায়গায় হয়তো পৌঁছতেই পারতাম না। ১৭ বছর বয়সে সই করেছিলাম লাল-হলুদে। আমার মতো ‘টিন এজার’কে খেলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ইস্টবেঙ্গলের কাছে সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব। এই ঋণ কখনওই শোধ করতে পারব না।
প্র: কাফা নেশনস কাপে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছেন। এ বার নিশ্চয়ই বিশ্রাম নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন?
গুরপ্রীত: কাফা নেশনস কাপ শেষ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের কাজ তো এখনও বাকি রয়েছে। সামনেই এএফসি এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে সিঙ্গাপুরের বিরুদ্ধে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ রয়েছে। মূল পর্বে যোগ্যতা অর্জন না-করা পর্যন্ত বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভাবতেও পারি না।