শরীরের গঠন সিংহের, মুখ ঘোড়ার মতো! বাংলার কোন বনেদি বাড়িতে দুর্গার বাহনে ব্যতিক্রম?
প্রতিদিন | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
অর্ণব দাস, বারাসত: স্বপ্নাদেশ ছিল মা দুর্গার বাহনের শরীরের গঠন সিংহ হলেও মুখ হবে ঘোড়ার মতো। প্রায় চারশো বছর ধরে একইভাবে সেই প্রতিমা পূজিত হচ্ছে দত্তপুকুরের দত্তবাড়িতে। বাংলার ১০৩১ বঙ্গাব্দে দত্তপুকুরের নিবাধুই এলাকায় পারিবারিক দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নায়েব জটাধারি দত্ত। পরবর্তীতে অবশ্য রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের থেকে জমিদারিত্ব পেয়েছিলেন তিনি। সেই থেকেই বংশ পরম্পরায় দুর্গাপুজো করে আসছে দত্ত পরিবার।
এপার বাংলায় জটাধারির আসার কারণ অবশ্য পারিবারিক অশান্তি। কথিত আছে, বিবাদ চলাকালীন তাঁর খাবারের থালায় ভাতের পরিবর্তে ছাই দেওয়ায় অভিমানে দত্তপুকুরের চলে এসেছিলেন জটাধারি দত্ত। তারপর তিনি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নায়েব হয়ে এলাকায় একাধিক পুকুর খনন করিয়েছিলেন। দত্তদের এই একাধিক পুকুর থাকায় মানুষের মুখে মুখে জনপদটির নামকরণ হয়েছিল দত্তপুকুর। পরিবারের সদস্যদের দাবি, এবছর দত্ত পরিবারের দুর্গাপূজো ৪০২ বছরে পড়ল। কথিত আছে, মা দুর্গার বাহন সিংহ। কিন্তু এই পরিবারের দেবী দুর্গার বাহনের মুখ ঘোড়া। এমনই নাকি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন জটাধারি দত্ত। সেই রীতি মেনেই এবছরও চণ্ডীদালানে জোরকদমে চলছে প্রতিমা তৈরির প্রস্তুতি।
রীতি মেনে রথের দিনই হয়েছে কাঠামো পুজো। বহু আগে বলি প্রথা ছিল। কিন্তু এখন আর সে সব হয় না। বংশ পরম্পরা অনুযায়ী দশমীর দিন পরিবারের প্রবীণ গৃহবধূ প্রথম মাকে বরণ করেন। তারপর পরিবারের অন্যান্য মহিলা এবং স্থানীয়রা বরণ করে সিঁদুর খেলেন। বিসর্জনের সময় চণ্ডী মন্দিরের বেদি থেকে মাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে বংশের প্রবীণ গৃহবধূই বেদিতে দই ঢালেন। যতক্ষণ না মায়ের বিসর্জন হয় ততক্ষণ বেদির সামনে সেই দইয়ে হাত দিয়ে বসে থাকেন তিনি। এরপর বিসর্জনে হাজির থাকা সকলকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। দত্ত পরিবারের প্রাচীন এই দুর্গাপুজো ঘিরে গোটা দত্তপুকুরের মানুষদের মধ্যেও উৎসাহ রয়েছে।
দত্তপরিবারের এই পুজোর ব্যাটন রয়েছে জটাধারি দত্তের ২০তম বংশধরের হাতে। প্রতিমার গায়ে মাটি দেওয়া থেকে বিসর্জন, খুঁটিনাটি সব বিষয়টি এখন দেখেন শঙ্খদীপ দত্ত। পরিবারের অন্যান্যদের সহযোগিতাও থাকে। পারিবারিক এই পুজোর ম্যানেজিং সেবায়েত হলেন রাজীব দত্ত। দত্ত পরিবারের অধীনে এখনও বেশ কয়েকটি পুকুর রয়েছে। বছরে লিজ দেওয়া হয় মাছ চাষের জন্য। এছাড়াও একসময়ে জমিদারের অধীনে থাকা নিবাধুই বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও প্রণামী নেওয়া হয়। সেই টাকায় পুজোর অনেকটাই সামাল দিতে পারেন দত্ত পরিবার।
পুজো প্রসঙ্গে বর্তমান বংশধর তারাশংকর দত্ত বলেন, “মহালয়ার পরের দিন থেকে নবমী পর্যন্ত আমি বংশের নিয়ম মেনেই আতপ চালের সেদ্ধ ভাত খাই।” তাঁর বড় ছেলে তথা দত্ত পরিবারের পুজোর ম্যানেজিং সেবায়েত রাজীব দত্ত বলেন, “দত্তপুকুরের মধ্যে আমাদের বাড়ির পুজোটাই প্রাচীন। তাই এই পুজো ঘিরে দত্তপুকুরের মানুষদের ব্যাপক উৎসাহ রয়েছে।” পরিবারের সদস্য শঙ্খদীপ বলেন, “পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে এই পুজো করতে পেরে আমরা গর্বিত। এই ঐতিহ্য আজীবন ধরে রাখতে চাই।”