• রামকৃষ্ণ-স্মৃতিধন্য গঙ্গাপ্রসাদ ভবনের দুর্গাপুজো, এসেছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় থেকে রঘু রাই
    প্রতিদিন | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • প্রসেনজিৎ দত্ত: কলকাতায় ‘কবিরাজ গলি’ নামে কোনও নির্দিষ্ট রাস্তা নেই। কিন্তু এই রাস্তা খুব সহজেই এমন নাম পেতে পারে। যে গলিতে ঢুকে রামকৃষ্ণ-স্মৃতিধন্য এই বাড়িতে পৌঁছানো, তা কিন্তু কলকাতার আয়ুর্বেদ আন্দোলনের ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছিল। এর বিপরীতেই আরও এক কবিরাজ বাড়ি, বিজয়রত্ন ভবন। বাইরের ফলকে জ্বলজ্বল করছে ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধিও। স্মৃতিস্তম্ভটি ভয়ানক ম্যাকলে নীতির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। এই নীতির মাধ্যমে দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়ার চক্রান্ত চলেছিল। আমাদের বিষয় আজ কলকাতার কবিরাজি চিকিৎসার ইতিহাস নয়, এক কবিরাজি বাড়ির দুর্গাপুজো।

    যে দরজা দিয়ে কুমোরটুলি স্ট্রিটের এই বাড়িতে ঢুকতে হয়, তার পাশের দেওয়ালে সাদা মার্বেলের উপর খোদাই করা— ‘ঠাকুরের দেহে ব্যাধি চিন্তিত নিরবধি/ মথুর মাথায় রাখে হাত/ রোগারোগ্য বাসনায় দেখাইতে আসে তাঁয়/ রুগী সাজে জগতের নাথ।’ সালটা ১৮৫৮। রানি রাসমণির জামাতা মথুরবাবুর আহ্বানে শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসার ভার গ্রহণ করলেন গঙ্গাপ্রসাদ। ধন্বন্তরি গঙ্গাপ্রসাদ দেখে বুঝলেন, এ যোগজ ব্যাধি! সারবার নয়। লেখা আছে সেই কথাও— ‘যোগজ ইহাকে বলে এই রোগ শুধু ছলে/ নিরাময় হইবার নয়।’ কুমোরটুলি স্ট্রিটের ১৭ নম্বর বাড়িটিকে নিয়েই আজ আমাদের আলোচনা।

    ঢাকা জেলার উত্তরপাড় কোমরপুকুর গ্রামের বাসিন্দা বদ্যি নীলাম্বর সেন। তাঁর ইচ্ছে, ভাগীরথীর তীরে জীবনের শেষ দিনগুলি কাটাবেন। কলকাতায় আসা-যাওয়ার সুবাদে দুর্গাচরণ লাহার সঙ্গে পরিচয় তাঁর। অবশেষে দুর্গাচরণ ও তাঁর পুত্র নবকৃষ্ণ দেবের বংশধর অভয়কৃষ্ণ দেবের বদান্যতায় নীলাম্বরের আটচালা ওঠে কুমোরটুলির গঙ্গাপাড়ে। সাল ১৮৪০। কুমোরটুলি স্ট্রিটের সেই পথে ডোবা। স্যাঁতসেঁতে পথের পোশাকে পোড়া ইট। এখান থেকে বিবর্তনের কথা অনেকেই জানেন কমবেশি। যা জানেন না, নীলাম্বর মহাশয় নিজের অন্তর্জলি করেছিলেন। গঙ্গায় শরীর চুবিয়ে অপেক্ষা মহামৃত্যুঞ্জয়ের। সেই তিনিই পুত্র গঙ্গাপ্রসাদকে (১২৩১-১৩০২) আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের পাঠ দেন। গঙ্গা সাক্ষী। আশিস দিয়ে পুত্রকে বলেন, ‘হাল ধরো চিকিৎসার। শুরু করো তোমার কবিরাজি। জগৎ বিখ্যাত হবেই।’ ১৮৪২ সালে প্রয়াণ ঘটে নীলাম্বরের।

    কাঁপা কাঁপা গলায় কথাগুলো বলছিলেন সতীপ্রসন্ন সেন। সেন বংশের অন্যতম উত্তরাধিকার তিনি। আজ, ২০২৫-এ তাঁদের বাড়ির দুর্গা পুজোর বয়স ১৮৫। বাড়ির দালানে ১৮৪০-এ শুরু করেছিলেন নীলাম্বর সেন। 

    এরপর পাকা হয় বাড়ি। পুজো চলতে থাকে রমরমিয়ে। ইতিমধ্যে সিপাহি বিদ্রোহ শেষ হয়ে গিয়েছে। বদ্যি গঙ্গাপ্রসাদ সেনের কথা ইংরেজদের জানা ছিল। শোনা যায়, উনিশ শতকের শেষের দিকে ভিক্টোরিয়া-নন্দন প্রিন্স অফ ওয়েলস রাজধানী কলকাতায় দরবার করেছিলেন। কিছুদিন পরেই ওয়েলসের নিদ্রাহীন রোগ হয়। গঙ্গাপ্রসাদের টোটকায় তিনি সেরে ওঠেন। তারপর থেকে ইংরেজরাও এই বাড়ির দুর্গাপুজোয় নিয়মিত আসা-যাওয়া করত। তাদের জন্য সপ্তমীর দিন দোতলার হলঘরে বল-ডান্সের আসর বসত। ১৮৭৭ সালে মহারানি ভিক্টোরিয়া চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষ দক্ষতার জন্য গঙ্গাপ্রসাদকে ‘রায়’ উপাধি দিলেন। এখানেই শেষ নয়। পিছিয়ে ছিলেন না আয়ুর্বেদজ্ঞ বিজয়রত্ন সেনও। এই ইংরেজ সরকারই তাঁকে দিলেন ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধি। ভাবুন একবার, এই ইংরেজরাই ফন্দি করে ম্যাকলে নীতির প্রবর্তন করে। ডিভাইন জাস্টিস হল এটাই, ইংরেজরাই দুই কবিরাজকে উপাধির ভূষণে ভূষিত করেছিল।

    গঙ্গাপ্রসাদ ভবনে পুজো তন্ত্রমতে। মহালয়ার এক সপ্তাহ আগেই শুরু উপাচার। চৌষট্টি যোগিনী আসন পাতা হয় দেবী বন্দনার জন্য। সপ্তমী-অষ্টমী সন্ধিপুজোয় অজিতা ও অপরাজিতা পুজো পান। দশভুজা হয়েও দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে পরাভূত করার শক্তি পাচ্ছিলেন না। ডেকে নিয়েছিলেন ভয়ংকরী দুই কালীশক্তি অজিতা ও অপরাজিতাকে। কালিকাপুরাণে এই কথা পাওয়া যায়। যাই হোক, অষ্টমীর দিনই ভাসান হয় কালীমূর্তির। তারপর শুরু হয় অষ্টমী পুজো।

    মৃন্ময়ী একচালার। হারু পাল চারপুরুষ ধরে গড়ছেন প্রতিমা। বাঁ-দিকে গণেশ। এটাই পরম্পরা। ভগবতী ‘শ্রী’ আর ‘ধী’ অর্থাৎ সমৃদ্ধি ও বুদ্ধির যুগ্ম প্রতিরূপে তিনি বামা। গণেশের উপস্থিতিও তাই বাঁ-দিকে। দশমীর দিন বড় গঙ্গাজলের গামলায় দর্পণে ছায়া দেখে প্রতিমা বিসর্জন হয়। আদি রীতি এটি। তা এই বাড়ির পুজো নিয়ে স্মরণীয় কোনও ঘটনার কথা মনে পড়ে? প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়েছিলাম গঙ্গাপ্রসাদ ভবনের আর-এক উত্তরাধিকার পার্থ সেনকে। অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে তিনি বললেন, ‘‘সালটা মনে নেই। তবে দু-দু’টো ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমরা তখন বাড়ির পুজো নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ দেখি, ‘গার্ড ডগ’ নিয়ে দু-তিনজন নিরাপত্তারক্ষীকে আমাদের বাড়ি ঢুকতে। আমরা তো অবাক! জানতে পারি, আমাদের পুজো দেখতে আসছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। সারপ্রাইজ ভিজিট ছিল সেটা।’’ আরও একটা ঘটনার কথা বলছিলেন… ‘‘হ্যাঁ, সেই ঘটনার স্মৃতিও টাটকা। এক বছর তো এসেছিলেন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার রঘু রাই। বললেন, কলকাতা নিয়ে কাজ করছেন। বেশ কিছুক্ষণ আমাদের বাড়ির পুজোর ছবি তুলে শোভাবাজার রাজবাড়ি যেতে চাইলেন। তাঁর সঙ্গে আমরাও দু’জন গিয়েছিলাম। তিনি এতটাই বিখ্যাত, সবাই তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বেশ মজা লাগছিল। যে মানুষটা ক্যামেরায় ধরতে এসেছেন পুজোর মুহূর্তগুলি, সেই মানুষটাকে নিয়েই সবাই ছবি তুলতে লাগলেন।’’

    ফেরার পথে দোতলার সেই বিরাট হলঘরে কান পাতি। শুনতে পাই কালের ধ্বনি। সপ্তমীর দিন সাহেবসুবোরা যেন আজও আসেন। পুজো দেখেন। যাত্রা হয়। স্মৃতির ভিড়ে ইতিহাস এখানে ফিকে হলেও বিস্মৃত নয়।
  • Link to this news (প্রতিদিন)