• পুজোয় নাটুয়ায় চমক! পালা জুড়ে শারদীয়ায় দেদার বরাত
    প্রতিদিন | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: শিব-দুর্গার বিবাহ নাচে জুড়েছে পালা। ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকা নাটুয়া নৃত্যে পালা জুড়ে দিয়ে এবার পুজোয় চমক আনছেন দেশ-বিদেশের মঞ্চ কাঁপানো প্রখ্যাত নাটুয়া শিল্পী গুণধর সহিস। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর ছেলে তাপস সহিসও। বাবা-ছেলের যুগলবন্দিতে পালার মাধ্যমে শিব-দুর্গার বিয়ের নাচ নাটুয়া এবার পুজোর মঞ্চে আলাদা নজর কাড়বে। পুরুলিয়া জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের মাধ্যমেই পুজোর সময় তিনটি অনুষ্ঠানের বরাত পেয়েছে ওই শিল্পীর কোনাপাড়া শিব-দুর্গা নাটুয়া নৃত্য দল। সেই সঙ্গে সরাসরি বরাত মিলেছে দুটি বেসরকারি সংস্থাতেও। এছাড়া পুজোর মরশুমে অনুষ্ঠানের জন্য ফোন এসেই যাচ্ছে এই নাটুয়া নৃত্য দলের কাছে। হারিয়ে যাওয়া শিল্পকলাকে যে পালার মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে সাজিয়ে তুলেছেন শিল্পী ৪৮ বছরের গুণধর সহিস। নয় পুরুষ ধরে তাঁরা এই নাচ নেচে যাচ্ছেন।

    পুরুলিয়া জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের আধিকারিক সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী বলেন, “প্রায় ৭০০ বছরের প্রাচীন এই নাটুয়া শিল্পকলা যাতে কোনোভাবেই হারিয়ে না যায় তাই এই লোক আঙ্গিকের উপর আমাদের মাঝেমধ্যেই কর্মশালা হয়ে থাকে। দপ্তরের তত্ত্বাবধানে পুরুলিয়ার নাটুয়া নিয়ে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ হয়েছে। আসলে লোকপ্রসার প্রকল্পের মাধ্যমেই অন্যান্য লোকশিল্পের মত প্রাচীন শিল্পকলার নাটুয়ারও পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। সেই কারণে পুজোর সময় আমাদের দপ্তরের তত্ত্বাবধানে এই শিল্পীরা বরাত পাচ্ছেন। এর থেকেই বোঝা যায় এই শিল্পীদের নিয়ে দপ্তর কতখানি সুসংহত ভাবে কাজ করছে। এছাড়া শিল্পীরাও সরাসরি বরাত পাচ্ছেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে তার যোগসূত্র আমরা করে দিচ্ছি। সবে মিলিয়ে পুজোর সময় সাবেক মানভূমের লোকশিল্প ঘিরে অর্থনীতি চাঙ্গা।”

    শিব-দুর্গার বিবাহের নাচ এই নাটুয়া। তাই পালাতেও সেই বিবাহের কথাকে রেখে নাটুয়া পালার নাম দেওয়া হয়েছে ‘হর-পার্বতীর মিলন’। আর সেই পালা তুলে ধরতে এখন চলছে অনুশীলন। সম্মিলিতভাবে না হলেও নানান কাজে ব্যস্ত থাকা শিল্পীরা আলাদা আলাদা ভাবে নাচ করে যাচ্ছেন। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর পর থেকে মিলিতভাবেই অনুশীলন চলবে বলে ওই দল জানিয়েছে। নাটুয়া বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বলরামপুরের পাঁড়দ্দা গ্রামের হাঁড়িরাম কালিন্দির নাম। কিন্তু আজ তিনি নেই। এখন এই শিল্পকলাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন জেলার দুই প্রখ্যাত শিল্পী গুণধর সহিস ও বীরেন কালিন্দী। পুরুলিয়ার পুঞ্চা ব্লকের কেন্দার কোনাপাড়ার বাসিন্দা গুণধর প্যারিস, আরব, বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন জায়গায় নাটুয়ার অনুষ্ঠান করেন। রাজধানী দিল্লিতে প্রায় ২০ থেকে ২৫ বার। মহানগর কলকাতায় তো একেবারে ধারাবাহিকভাবে চলছে অনুষ্ঠান। প্রয়াত সঙ্গীত শিল্পী বাপি লাহিড়ী তাঁকে মুম্বই নিয়ে গিয়েছিলেন নাটুয়া নাচের জন্য। এছাড়া বেঙ্গালুরু, হরিয়ানা, সিকিম হিমাচল প্রদেশ, কেরালা, গোয়া, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখান্ড। তাঁর নাটুয়ার দৃপ্ত পরিবেশনা থেকে বাদ যায়নি কার্যত আসমুদ্রহিমাচল। এবার পুজোয় ষষ্ঠীতে অনুষ্ঠান রয়েছে ঢাকুরিয়ার বাবুবাগানে। সপ্তমীতে ওই এলাকারই পি কে গুপ্তা ফাউন্ডেশন ২৯ নম্বর ব্যাংক কলোনি এলাকায়। অষ্টমীতে টালিগঞ্জের অনুষ্ঠানও প্রায় পাকা। একাদশীতে মধ্যমগ্রাম। আর লক্ষ্মীপুজোর পর একেবারে সুন্দরবন। এই কোনাপাড়া শিব দুর্গা নাটুয়া নৃত্য দলের ওস্তাদ গুণধর সহিস নিজেই।

    তাঁর কথায়, “পুজোর মরশুমে আপাতত পাঁচটি অনুষ্ঠান পুরোপুরি পাকা। আরও বহু সংস্থা থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। সেগুলো দু-একদিনের মধ্যে চূড়ান্ত হয়ে যাবে। ষষ্ঠী ও সপ্তমীর দু’দিনের অনুষ্ঠান সরকারি তরফ থেকে পাওয়া। এই শিল্পকলাকে বাঁচিয়ে রাখতেই পালা তৈরি করেছি। তবে শিল্পকলার আদি রস কোনোভাবেই নষ্ট করিনি। এই লোক আঙ্গিকে অতীতের সবটাই অক্ষত রয়েছে।”

    ১৫ জনের দলে পুজোয় সরকারি তত্ত্বাবধানে বরাত পাওয়া প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানেই বিধি মেনে প্রত্যেক জন শিল্পী ১ হাজার করে টাকা পাবেন। সঙ্গে গাড়ি খরচ ও খাওয়া। সুন্দরবনে নাটুয়ার সঙ্গে গুণধর সহিসের কোনাপাড়া হরিজন সংঘ ছৌ নৃত্য দলও সেখানকার মঞ্চ কাঁপাবে। নাটুয়ার মতো শিল্পী তাঁর ছৌ দলেও নতুন দুটি পালা সাজান। একটি ‘সন্ধ্যা আরতির জন্ম’। আরেকটি ‘অন্ধকাসুর বধ’ এছাড়া আরও একটি নতুন পালায় হাত দিয়েছেন যা দুর্গা পুজোর পর সামনে আসবে বলে শিল্পী জানান। শিব-দুর্গা বিবাহের এই নাচের শিল্পকলাকে ঘিরে পৌরাণিক গল্প রয়েছে। সেই কথাই বলছিলেন শিল্পী গুণধর।

    তাঁর কথায়, ” যখন শিব-দুর্গার বিবাহ ঠিক হয় তখন দেবতারা ভাবতে থাকেন কিভাবে একটা নৃত্যানুষ্ঠান হবে। তখন তো কোন বাজনা ছিল না। তবে মহাদেব নৃত্য শুরু করেন। পালাতে এই বিষয়টি রয়েছে।” শিবের ওই নাচ বা নটরাজ নৃত্যে যে মুদ্রার ব্যবহার হয়ে আসছে তা নাটুয়া নাচে রয়েছে। শিল্পী গুণধর সেই নটরাজ নৃত্য এই শিল্পে তুলে ধরেন। দন্তশক্তিতে তুলে ফেলেন আস্ত ঢেঁকি। দাঁতের কামড়ে ঢাক ঘোরানো তো কোন ব্যাপারই না। নিজেই বলেন এ কথা। শরীরে চারজনকে নিয়ে দু’হাতে দুজনকে পাক খাওয়ান। হাতে তুলে নেন সিঁড়ি। গরুর গাড়ির চাকা হাতে নেচে ওঠেন। কিন্তু এমন বীররসের নাচের জন্য খাওয়া-দাওয়া কি হয়? শিল্পীর কথায়, ঘরে যা জোটে সেটাই পেটপুরে খায়।

    শিব-দুর্গার নাচ নাচলেও এখনও অভাব গোচেনি গুণধরের পরিবারের। আগের মাটির বাড়ি সম্পূর্ণ পাকা না হলেও দেওয়াল উঠেছে। নিজে ক্লাস এইট পাশ হলেও ছেলেকে কোনভাবে স্নাতক করাবেনই এই শপথ নিয়েছেন। দুই মেয়েও গান-বাজনাতে যুক্ত ছিলেন। তবে তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাঁর বাবা বাবুলাল সহিস, জেঠু খেড়ু সহিস ঠাকুরদা নরসিংহ সহিস। সকলেই এই শিল্পকলার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও দিনমজুরি করতেই হত। সেই দিনমজুরির কাজ করেছেন গুণধরও। তবে বাবা ঠাকুরদার মত জঙ্গলে কাঠ কুড়িয়ে তা বিক্রি করতে হয়নি। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে কম কষ্ট করতে হয়নি শিল্পী গুণধরকে। জন্মের এক বছরের মাথায় শিল্পীর মা মারা যাওয়ায় জেঠিমার কাছেই বড় হয়ে ওঠেন। বাবা-র সঙ্গে ৫ বছর বয়স থেকেই নাটুয়ার আসরে যেতেন গুণধর। তারপরেই কখন যে নাটুয়া শিল্পী বনে গিয়েছেন তা তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি। এই শিল্পের এমনই জাদু যে কুম্ভ মেলাতেও এই শিল্পকলা তুলে ধরতে তাঁর কাছে আমন্ত্রণ আসে। ফলে উজ্জয়নী, হরিদ্দার, প্রয়াগরাজ, নাসিক কোন কিছুই বাদ যায়নি।
  • Link to this news (প্রতিদিন)