• 'ওঁর উপর অশরীরীর প্রভাব'! নিজের ফুটফুটে সন্তানকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিলেন, কী বলছেন চিকিৎসকেরা?  
    আজকাল | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: উত্তর প্রদেশের মোরাদাবাদের জব্বার কলোনিতে এক চাঞ্চল্যকর ও হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। ২৩ বছর বয়সী এক যুবতী এবং এক নবজাতকের মা প্রসবোত্তর সাইকোসিস নামক মানসিক রোগে ভুগছিলেন। তিনি তাঁর ১৫ দিন বয়সী সন্তানকে ফ্রিজে রেখে ঘুমাতে যান। সৌভাগ্যবশত শিশুটি বেঁচে যায়, কারণ তার কান্নার আওয়াজ শুনে দিদা ছুটে গিয়ে তাকে উদ্ধার করেন। আর এই ঘটনা ঘিরে তোলপাড় চারিদিকে৷ 

    খবর অনুযায়ী ঘটনাটি ঘটে ৫ই সেপ্টেম্বর। ওই যুবতী তাঁর সন্তানকে নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজের ভিতর রেখে দেন এবং তারপর নিজ ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। শিশুর করুণ কান্না শুনে পরিবারের সদস্যরা ছুটে গিয়ে তাকে দ্রুত বের করে আনেন। প্রথমে পরিবারের লোকজন ভেবেছিলেন যে যুবতী কোনও অশরীরী বা অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রভাবের শিকার। এজন্য তাঁরা স্থানীয় এক তান্ত্রিকের শরণাপন্নও হন। তবে যখন তাতেও অবস্থার উন্নতি হয়নি, তখন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে জানা যায়, তিনি প্রসবোত্তর সাইকোসিসে ভুগছেন।

    এই ভয়াবহ ঘটনার পর সমগ্র এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই নতুন মায়েরা প্রসব-পরবর্তী মানসিক রোগে আক্রান্ত হলেও তা অজান্তেই থেকে যায় বা উপেক্ষিত হয়। এই ঘটনার পর বলিউড অভিনেত্রী ইশিতা দত্ত নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে সামাজিক মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেন। তিনি বলেন, প্রথম সন্তান জন্মের পর তিনি চরম মানসিক চাপ ও হতাশায় ভুগেছিলেন। বারবার কান্নায় ভেঙে পড়তেন এবং বুঝতেই পারতেন না কেন এমন হচ্ছে।'হরমোনের তারতম্য, শরীরের ব্যথা, দুই ঘণ্টা পর পর দুধ খাওয়ানো, একেবারেই ঘুম নেই,'- বলেন তিনি। তবে দ্বিতীয় সন্তানের সময় অভিজ্ঞতা কিছুটা অন্যরকম ছিল। তিনি জানান, পরিবার ও প্রিয়জনদের সহায়তা এবং নিজের শরীর-মন সম্পর্কে সচেতনতা তাঁকে অনেক সাহায্য করেছে। তিনি বলেন, 'যদি আপনি প্রসবোত্তর বিষণ্ণতায় ভুগে থাকেন, জেনে রাখুন এটা বাস্তব, এটা সত্যি হয়। আপনি একা নন।'

    চিকিৎসকেরা জানান, প্রসব-পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হালকা 'বেবি ব্লু থেকে শুরু করে গুরুতর অবস্থার দিকে গড়াতে পারে, যার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো প্রসবোত্তর সাইকোসিস। অধিকাংশ মায়ের ক্ষেত্রেই সন্তান জন্মের পর প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া বা হঠাৎ আবেগ প্রবণতা দেখা যায়, যাকে বলা হয় 'বেবি ব্লু'। এটি সাধারণত বিশ্রাম ও পারিবারিক সহায়তার মাধ্যমে সেরে যায়।

    তবে কিছু মায়ের ক্ষেত্রে এই অবস্থাই রূপ নেয় প্রসবোত্তর বিষণ্ণতায়। শুধু মন খারাপ থাকা নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী দুঃখবোধ, উদ্বেগ, ক্লান্তি এবং সন্তানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। দৈনন্দিন কাজকর্মও তখন ভারী মনে হতে পারে, এবং এই অবস্থা সপ্তাহ বা মাস ধরে চলতে পারে।

    প্রসব-পরবর্তী মানসিক রোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হলো প্রসবোত্তর সাইকোসিস। এটি খুবই বিরল হলেও প্রাণঘাতী হতে পারে। এতে মা বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত হন, বিভ্রম, মানসিক বিভ্রান্তি, ভুল সিদ্ধান্তগ্রহণ, এমনকী নিজের বা শিশুর ক্ষতির চিন্তাও মাথায় আসতে পারে।

    বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যানুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতি পাঁচজন মায়ের মধ্যে একজন প্রসবোত্তর বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন। তবে সাইকোসিসের হার তুলনামূলকভাবে কম- প্রতি ১,০০০ জনে ১ থেকে ২ জন। এই সময় স্বামীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি স্ত্রীর বিশ্রাম ও মানসিক স্বস্তি নিশ্চিত করাও প্রয়োজন। রান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কাপড় ধোয়ার কাজগুলো ভাগ করে নেওয়া, স্ত্রীর খাওয়াদাওয়া ও আরামের বিষয়গুলোতে যত্নবান হওয়া উচিত। স্ত্রীর আবেগগত অবস্থার দিকে খেয়াল রাখা, মন দিয়ে শোনা, এবং প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের সাহায্য নিতে উৎসাহ দেওয়া- এসবই প্রসবোত্তর মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

    কর্মজীবী মায়েদের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। একদিকে সন্তান, অন্যদিকে কাজের চাপ এবং পারিবারিক দায়িত্ব - সবকিছু সামলাতে গিয়ে অনেকেই মানসিক চাপের শিকার হন। তাই পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীদের সহানুভূতি ও সহায়তা একান্ত প্রয়োজন। অফিসের পক্ষ থেকে মাতৃত্বকালীন ছুটি, ফ্লেক্সিবল সময়সূচি, এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তামূলক নীতি থাকা দরকার।

    সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- কোনও মা যদি বুঝতে পারেন তিনি একা কিছু সামাল দিতে পারছেন না, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। একজন মায়ের সুস্থতাই একটি পরিবারের ভিত্তি, এবং তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য যতটা গুরুত্ব পাওয়ার দাবিদার, ততটাই গুরুত্ব পাওয়া উচিত।

    মোরাদাবাদের এই ঘটনাটি তাই শুধুই একটি মর্মান্তিক খবর নয়, বরং গোটা সমাজের জন্য একটি সতর্কবার্তা। সময় এসেছে প্রসবোত্তর মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে আরও সচেতনতা গড়ে তোলার এবং প্রতিটি মায়ের পাশে দাঁড়ানোর।
  • Link to this news (আজকাল)