ভারতের প্রজনন হারে ঐতিহাসিক পতন! জনসংখ্যা বদলের দ্বারপ্রান্তে দেশ
আজকাল | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: নতুন তথ্য বলছে, ভারত এক নতুন জনমিতিক যুগে প্রবেশ করছে। রেজিস্ট্রার জেনারেল অফিস ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (SRS) স্ট্যাটিস্টিকাল রিপোর্ট ২০২৩ অনুযায়ী, গ্রামীণ ভারতের প্রজনন হার নেমে এসেছে ২.১–এ, যা জনসংখ্যা পুনর্গঠন বা রিপ্লেসমেন্ট লেভেল হিসেবে ধরা হয়। এই স্তরে পৌঁছানো মানে জন্ম ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় সমান হয়ে যাওয়া। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ভারতের প্রেক্ষাপটে এই মাইলফলক শুধু স্থিতিশীলতার সূচক নয়; এটি আসন্ন বৃদ্ধ জনসংখ্যা সংকটের পূর্বাভাসও বটে।
সাম্প্রতিক SRS তথ্য বলছে, ভারতের সামগ্রিক প্রজনন হার নেমে দাঁড়িয়েছে ১.৯-এ, যা ইতিমধ্যেই প্রতিস্থাপন স্তরের নিচে। শহরে এ হার আরও কম, মাত্র ১.৫। হিন্দুস্তান টাইমস এই ২.১ মাত্রাকে “সমালোচনামূলক” আখ্যা দিয়ে লিখেছে—ভারত তার দীর্ঘকালীন জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধাপ শেষ করে এক “ধূসর যুগে” প্রবেশ করছে। অর্থাৎ, ছোট পরিবার, শ্রমশক্তির ধীর বৃদ্ধি, এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠীর যত্নের চাপ আরও প্রকট হয়ে উঠবে। এর আগে জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (NFHS-5, ২০১৯–২১) মোট প্রজনন হার ২.০ নথিভুক্ত করেছিল। ফলে বোঝা যাচ্ছে, এটি এককালীন পরিবর্তন নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি নিম্নগামী প্রবণতারই অংশ।
যেখানে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের বহু রাজ্য বহু বছর ধরেই প্রতিস্থাপন স্তরের নিচে আছে, সেখানে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু রাজ্যে এখনও প্রজনন হার তুলনামূলকভাবে বেশি। অর্থাৎ, একই দেশের ভেতরে নীতি ও অগ্রাধিকারে বড় ধরনের ফারাক রয়ে গেছে। পতনের প্রধান কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে, মেয়েদের শিক্ষাবর্ষ বৃদ্ধি, বিয়ের বয়স ও মাতৃত্বের বয়স পিছিয়ে যাওয়া, গর্ভনিরোধক পদ্ধতির সহজলভ্যতা, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, শহরমুখী জনসংখ্যা স্থানান্তর, এবং সন্তান পালনের ব্যয় বৃদ্ধি (শিক্ষা থেকে শুরু করে বাসস্থান পর্যন্ত)—এই সব মিলেই ভারতের জনসংখ্যার হ্রাসকে ত্বরান্বিত করেছে।
দিল্লির এক গৃহকর্মী আশা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন—“এখন দম্পতিরা বড়জোর জিজ্ঞাসা করে কীভাবে কম সন্তান রাখা যায়। প্রশ্ন আর ‘কতজন সন্তান’ নয়, বরং ‘কীভাবে ভালোভাবে সন্তানকে বড় করা যায়’।” NITI Aayog–এর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ পরিচালক হেমন্ত কুমার মীনা বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই জনসংখ্যাগত একটি সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করেছি, এখন প্রশাসনিক প্রস্তুতি নেওয়ার পালা।”
এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সামনে আসছে কয়েকটি মূল খাত—
শিক্ষা ও পুষ্টি: ছোট পরিবার মানে বেশি প্রত্যাশা; স্কুল ও মিড-ডে মিল প্রকল্পকে আরও কার্যকর করতে হবে।
পরিবার পরিকল্পনা: মহিলাদের নির্বীজকরণের অস্ত্রোপচারের বাইরে গিয়ে বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণ করা।
কেয়ার ইকোনমি: শিশুশালা (ক্রেশ), বৃদ্ধদের যত্ন রাখার কেন্দ্র, এবং স্কুলের সময়কে কর্মঘণ্টার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া।
বৃদ্ধ সমাজের প্রস্তুতি: প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালী করা, সময়ে পেনশন প্রদান, এবং কম প্রজনন হার যুক্ত রাজ্যে (যেমন কেরালা, দিল্লি) ‘অ্যাসিস্টেড লিভিং’ মডেল গড়ে তোলা।
অভিবাসন: বহনযোগ্য সামাজিক সুবিধা, সুলভে ভাড়া বাড়ি, এবং চলমান শ্রমিক পরিবারদের জন্য স্থানান্তরযোগ্য ক্রেশ।
লিঙ্গ অনুপাত: কন্যা ভ্রূণ হত্যা রোধে কঠোর নজরদারি, মেয়েদের উন্নয়নে সমান বিনিয়োগ।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রচারণা এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়। ভারতের সামনের আসল কাজ হলো—একটি ছোট পরিবারভিত্তিক সমাজকে সমর্থন করতে সক্ষম শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও যত্নব্যবস্থা গড়ে তোলা। কারণ দ্রুত পতনশীল প্রজনন হার ভারতকে এক ‘পোস্ট-গ্রোথ’ যুগে ঠেলে দিয়েছে।