আজকে ওয়েবডেস্ক: বিজেপির নতুন সভাপতি নির্বাচনের বিষয়টি কেন্দ্র করে আবারও প্রকাশ্যে চলে এসেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের মধ্যে টানাপোড়েন। বিজেপির সাংগঠনিক সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে যে দল ও সংগঠনের মধ্যে মতবিরোধ শুধু গুজব নয়, বাস্তব। তবুও, বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) ভাগবতের ৭৫তম জন্মদিনে মোদীর শ্রদ্ধাঞ্জলি রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল তৈরি করেছে। ভাগবতের ব্যক্তিগত দিকগুলো তুলে ধরে মোদী তাঁকে ‘আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ নেতা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। জন্মদিনের বার্তাটি এতটাই প্রশস্তি-ভরা যে অনেকেই বলছেন, এটি যেন কোনও আজীবন সম্মাননা অনুষ্ঠানের বক্তৃতা।
ভাগবতের জন্মদিনকে ঘিরে আরেকটি আলোচনার বিষয়—আরএসএসে প্রচলিত ৭৫ বছর বয়সে অবসরের অঘোষিত নিয়ম। ভাগবত এ প্রসঙ্গে সরাসরি বলেছেন, “আমরা স্বয়ংসেবক, দায়িত্ব দেওয়া হলে তা ফিরিয়ে দেওয়ার অধিকার নেই। যতদিন সংগঠন চাইবে, ততদিন কাজ করব।” এই বক্তব্য ইঙ্গিত করে যে ভাগবত নিজেকে অবসরের বাইরে রাখতে চান। জেপি নাড্ডার মেয়াদ ২০২৪ সালের জানুয়ারিতেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু একাধিক বর্ধিত সময়সীমার পরও নতুন সভাপতি নির্বাচিত হয়নি। এর কারণ বিজেপি ও আরএসএসের মধ্যে সম্মতির অভাব। মোদী-অমিত শাহ চাইছেন এমন একজন সভাপতি যিনি তাঁদের নির্দেশেই চলবেন। অপরদিকে আরএসএস চাইছে এমন একজন স্বাধীনমনা নেতা যিনি ‘রাবার-স্ট্যাম্প’ নন এবং প্রয়োজনে মোদীর ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন।
দলীয় সংবিধান অনুযায়ী সভাপতি নির্বাচনের জন্য কমপক্ষে ১৮ রাজ্যে সংগঠন নির্বাচন সম্পন্ন করা আবশ্যক। বছরখানেক বিলম্বের পর আরএসএস হস্তক্ষেপ করে কয়েকটি রাজ্যে প্রবীণ কিন্তু নিরপেক্ষ নেতাদের রাজ্য সভাপতি করে দিয়েছিল। তাতে ন্যূনতম শর্ত পূরণ হলেও কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচনে অচলাবস্থা কাটেনি। সংঘের ভেতরের সূত্রে জানা গেছে, পরিস্থিতি সবচেয়ে জটিল হয়েছে সঞ্জয় জোশীর নাম প্রস্তাব করার পর। জোশী দীর্ঘদিন মোদীর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। ২০০৫ সালে একটি ভুয়া ভিডিও কেলেঙ্কারির পর তিনি জনসমক্ষে সরে দাঁড়ালেও, ২০১২ সালে মোদীর চাপে তাঁকে বিজেপির জাতীয় নির্বাহী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে আরএসএস তাঁকে পুনর্বহাল করার চেষ্টা করলেও মোদী প্রতিবারই তা ব্যর্থ করেছেন।
আরএসএস এবার ফের জোশীর নাম প্রস্তাব করে সরাসরি মোদীর কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। জোশীকে সাদামাটা জীবনযাপন, ট্রেনে স্লিপার ক্লাসে ভ্রমণ এবং সংগঠনশীলতার জন্য সম্মান করা হয়। তাঁর প্রস্তাবিত নামকরণ স্পষ্টতই মোদীর আড়ম্বরপূর্ণ ব্যক্তিত্বের বিপরীতে একটি বার্তা। আরএসএসের পছন্দের তালিকায় ছিলেন কৃষিমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানও। তবে তিনি নিজেই জানান, বর্তমান মন্ত্রিত্বেই তিনি সন্তুষ্ট। এছাড়া ধীরেন্দ্র প্রধন ও ভূপেন্দ্র যাদবের নামও ঘুরপাক খাচ্ছে। দুজনেই আরএসএস ঘনিষ্ঠ হলেও মোদী-শাহের আস্থাভাজন মন্ত্রী হওয়ায় তাঁদের নিরপেক্ষ ভাবা কঠিন।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর বিজেপির আসন কমেছে। এই ফলাফল মোদীর অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাবমূর্তিকে কিছুটা দুর্বল করেছে। ফলে আরএসএস মনে করছে, এটাই সময় বিজেপিতে নিজের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার। তবে দ্বন্দ্ব কতদূর যাবে, তা নির্ভর করছে সভাপতি নির্বাচনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে। আগামী বিহার নির্বাচনের আগে সভাপতি নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে। আরএসএস চাইছে ‘নিজেদের একজন’—যিনি ভবিষ্যতে মোদীর উত্তরসূরী হিসেবেও উঠে আসতে পারেন। বিজেপি সভাপতি নির্বাচন আজ আর কেবল সাংগঠনিক প্রক্রিয়া নয়, বরং এক পারিবারিক লড়াই। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে সবসময় তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়েছে। কিন্তু আরএসএস এবার অন্য কিছু ভাবছে। সমঝোতা হবে কি না, এখন সেটাই বড় প্রশ্ন। তবে রাজনৈতিক মহলের অভিমত, এ লড়াই একপক্ষকে জয়ী করে থামবে—হয় মোদী-শাহ, নয় আরএসএস।