• ভারতে কেন চলতি বছরে এত বৃষ্টি? রয়েছে হাজার মাইল দূরের কোন প্রভাব
    আজকাল | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: কয়েকটি সাম্প্রতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ভারতীয় মৌসুমি বৃষ্টির প্রাথমিক বিবর্তন এবং আন্টার্কটিকায় বরফচাদর গঠনের মধ্যে এক চমকপ্রদ সম্পর্ক উদ্ঘাটন করেছেন।

    পালিওজিওগ্রাফি, পালিওক্লাইমাটোলজি, পালিওইকোলজি নামের আন্তর্জাতিক বইতে প্রকাশিত এই গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রায় ৩৪ মিলিয়ন বছর আগে আন্টার্কটিকায় যখন প্রথমবারের মতো বরফ জমতে শুরু করে, তখনই বিশ্বের বৃষ্টিপাতের ধরণে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতে, যেখানে তীব্র মৌসুমি বৃষ্টির সূত্রপাত ঘটে।

    এই সূত্র পাওয়া গেছে নাগাল্যান্ডের লাইসঙ ফরমেশন থেকে উদ্ধার হওয়া একটি জীবাশ্ম পাতার মাধ্যমে। গবেষকরা ক্লাইমেট লিফ অ্যানালাইসিস মাল্টিভেরিয়েট প্রোগ্রাম নামের বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে সেই পাতার আকার, গঠন ও শিরা-বিন্যাস বিশ্লেষণ করেছেন। এর ভিত্তিতে তারা কোটি কোটি বছর আগেকার আবহাওয়া পুনর্গঠন করতে সক্ষম হন। ফলাফলে দেখা যায়, বর্তমানের তুলনায় সেই সময় নাগাল্যান্ডে জলবায়ু ছিল অনেক বেশি উষ্ণ ও আর্দ্র।

    লখনউ-এর বিরবল সাহনী ইনস্টিটিউট অব প্যালিওসায়েন্সেস এবং দেরাদুনের ওয়াদিয়া ইনস্টিটিউট অব হিমালয়ান জিওলজি–এর বিজ্ঞানীরা এই গবেষণা পরিচালনা করেছেন। তারা দেখিয়েছেন, আন্টার্কটিকার বরফচাদরের বৃদ্ধি পৃথিবীর প্রধান বর্ষণ বলয়, অর্থাৎ ইন্টারট্রপিকাল কনভার্জেন্স জোন (ITCZ)-কে বিষুবরেখার কাছাকাছি সরিয়ে আনে।

    এই সরে আসা আইটিসিজেডের কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বর্ষণের তীব্রতা হঠাৎ বেড়ে যায়। একইসঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও বায়ুপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাতের ধরনে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। গবেষণার ফলাফল আন্টার্কটিকার প্রাথমিক হিমায়নের বিশ্বের সময়সীমার সঙ্গেই মিলে যায়। ফলে বিজ্ঞানীরা একে মেরু অঞ্চলের বরফ গঠনের সঙ্গে ক্রান্তীয় মৌসুমি বৃষ্টির সরাসরি যোগসূত্র হিসেবে দেখছেন।

    তবে এই গবেষণা কেবল অতীতের আবহাওয়ার গল্প বলেই থেমে যায় না, বরং বর্তমান সময়ের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। আজকের দিনে আইটিসিজেডের অবস্থান পরিবর্তন হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার মৌসুমি বৃষ্টির ধরণ অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালে পশ্চিম ভারতে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হলেও উত্তর-পূর্ব ভারতে বৃষ্টি আশানুরূপ হয়নি। এটি আসলে আইটিসিজেড দক্ষিণমুখী সরে যাওয়ার ফলাফল। একই ধরনের চরম আবহাওয়া পাকিস্তান ও চীনেও দেখা গেছে।

    ভারতে লক্ষ লক্ষ কৃষক এখনও বৃষ্টিনির্ভর চাষাবাদের ওপর নির্ভরশীল। মৌসুমি বৃষ্টির এমন অস্থির পরিবর্তন একদিকে খরার ঝুঁকি বাড়ায়, অন্যদিকে প্রবল বন্যার সম্ভাবনাও তৈরি করে। ফলে মানুষের জীবিকা ও খাদ্যনিরাপত্তা দুটোই সংকটে পড়ে।

    গবেষক দলের মতে, এই আবিষ্কার প্রমাণ করে পৃথিবীর জলবায়ু কতটা গভীরভাবে আন্তঃসংযুক্ত। মেরু অঞ্চলে ঘটে যাওয়া ঘটনাও হাজার কিলোমিটার দূরে ক্রান্তীয় অঞ্চলের জীবনযাত্রাকে আমূল বদলে দিতে পারে। কোটি কোটি বছর আগেকার এই পরিবর্তনগুলি বোঝা গেলে বর্তমান জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় নতুন দিশা মিলতে পারে।

    বিজ্ঞানীরা বলছেন, আজকের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে অতীতের পাঠকে উপেক্ষা করা যাবে না। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এক প্রান্তের বরফ গলন কিংবা বৃদ্ধি, অন্য প্রান্তে বৃষ্টি ও জীবনের ভাগ্য নির্ধারণ করতে সক্ষম। তাই প্রাচীন মৌসুমী বৃষ্টির গল্প কেবল ইতিহাস নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা।
  • Link to this news (আজকাল)