ওজনে নয়, পশ্চিমবঙ্গের এই বাজারে টাটকা পদ্মার ইলিশ বিক্রি হয় 'থালা' হিসেবে, বহু লোকই জানেন না এই বাজারের সন্ধান ...
আজকাল | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: এক অদ্ভুত বাজার। এই বাজারে ক্রেতা আছে, বিক্রেতা আছে, বিক্রির জন্য মাল আছে , রোজ প্রচুর টাকার বিকিকিনি হয়। অথচ সেই মাল ওজন করে বিক্রি করার জন্য এই বাজারে কোনও বিক্রেতার কাছে নেই কোনও দাড়িপাল্লা, বাটখারা বা ওজন করার মেশিন। কিন্তু তবুও এই বাজারে গেলে ঠকে যাওয়ার ভয় করেন না কোনও ক্রেতা। রোজ বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্রেতাদের ভিড়ে জমজমাট থাকে এই বাজার।
আর এই অদ্ভুত বাজার দেখতে হলে আপনাকে আসতে হবে মুর্শিদাবাদ জেলায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের লালগোলায়। সেখানে নেতাজি মোড়ের কাছে অবস্থিত মীন বাজারের কাছে নিত্যদিন বসে তাজা মাছের এমনই এক অদ্ভুত বাজার। এই বাজারে কোনও মাছ ওজন হিসেবে বিক্রি হয় না। পদ্মা নদী থেকে ধরা সমস্ত ধরণের মাছ এখানে থালা হিসেবে বিক্রি হয়।
মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা ব্লক বরাবরই পদ্মা নদীর বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু এবং টাটকা মাছের জন্য বিখ্যাত। এই ব্লকের প্রচুর মানুষ পদ্মা নদী থেকে মাছ ধরে সেই মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করার পেশার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। ফলে লালগোলায় পদ্মা নদীর তাজা মাছ পেতে হলে আপনাকে যেতেই হবে নেতাজি মোড়ের কাছে মীন বাজারে। এখানে প্রায় ৫০-৬০ জন মাছ বিক্রেতা 'কমিশনের' ভিত্তিতে যে মাছ বিক্রি করেন তা থালা হিসেবে বিক্রি করা হয়।
লালগোলার বাসিন্দ নির্ঝর সিংহ বলেন,'গত বেশ কয়েক বছর ধরে নেতাজি মোড় এলাকায় থালা হিসেবে মাছ বিক্রি হয়। লালগোলা ব্লকে প্রায় ২৫০ জন মৎস্যজীবী সকাল থেকে পদ্মা নদীতে যে মাছ ধরেন তা এই বাজারে এসে অন্য কয়েকজন মৎস্যজীবীর হাতে দিয়ে দেন। এরপর মাছ বিক্রি করে যে আয় হয় তার 'কমিশন' ভাগ হয়ে যায় মাৎসজীবীদের মধ্যে।' লালগোলার এই বিখ্যাত থালা হিসেবে বিক্রি হওয়া মাছের বাজারে পদ্মা নদীর ইলিশ ,রুই, কাতলা, মৃগেল ছাড়াও মেলে পিউলি ,কাজলি ,বোয়াল, বাঘা আর-সহ হরেক রকমের নদীর মাছ। আর পদ্মা নদীর টাটকা মাছ পাওয়ার আশায় রোজ এই বাজারে ভিড় জমান লালগোলা-সহ মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন প্রান্তের প্রচুর মানুষ।
পিয়াল ঘোষ নামে বহরমপুরের এক বাসিন্দা লালগোলার বাজারে মাছ কিনে বলেন,'বহরমপুরের বাজারে যে ইলিশ পাওয়া যায় তার সবই বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করা। তবে পদ্মা নদীর তাজা ইলিশের স্বাদই আলাদা। তাই বহরমপুর থেকে ট্রেনে লালগোলা এসে আমি এই বাজার থেকে একটি থালায় রাখা পদ্মার ইলিশ ১৩০০ টাকায় কিনলাম। হাতে নিয়ে মনে হচ্ছে এই মাছের ওজন ১ কেজির বেশিই হবে।' বাবুসোনা হালদার নামে ওই বাজারের এক মাছ বিক্রেতা বলেন,' এখানে আমরা থালা বা 'প্লেট' হিসেবে ঠিকা দরে মাছ বিক্রি করি। যেদিন যে মাছের আমদানি বেশি হয় সেদিন সেই মাছের দাম কম থাকে।' তবে বাজারের বেশিরভাগ বিক্রেতাই জানিয়েছেন এখন পদ্মা নদীর এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশের দাম ২০০০ টাকার নিচে নয়।
ওই বাজারের মাছ বিক্রেতারা বলেন, সকাল থেকে লালগোলার বিভিন্ন এলাকার মৎস্যজীবীরা নিজেদের ডিঙ্গি নৌকা করে পদ্মা নদী থেকে যে মাছ ধরেন তা এমনভাবে সংরক্ষণ করা হয় যেন তা বিকেলেও একদম টাটকা থাকে। এই বাজারে এলে অনেক সময়ই পদ্মা নদী থেকে ধরা রুই, কাতলা, মৃগেল বোয়াল এবং অন্যান্য মাছদের খাবি খেতে বা লেজ ঝাপটাতে দেখা যায়। তার ফলে এই বাজারে পচা মাছ পাবার কোনও সম্ভাবনা থাকে না বলেই এলাকাবাসীরা জানিয়েছেন। অন্যদিকে থালা হিসেবে মাছ বিক্রি করলেও মুনাফা যে ভালোই থাকে তা স্বীকার করে নিয়েছেন বেশিরভাগ মৎস্যজীবী। তাঁরা বলেন, পদ্মা নদী থেকে ধরা ভালো প্রজাতির মাছ আড়তে বিক্রি করলে আরতদাররা আমাদের কাছে কম দামে কিনে সেই মাছ বিক্রেতাকে বেশি দামে বিক্রি করবে। সে কারণেই আমরা সরাসরি পদ্মা নদী থেকে ধরা মাছ থালা হিসেবে বিক্রি করি।
লালগোলা ব্লক তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি মোতাহার হোসেন রিপন বলেন,'অদ্ভুত এই মাছের বাজার বর্তমানে লালগোলার এক ঐতিহ্য। থালা হিসেবে মাছ বিক্রির খবর বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে জানতে পেরে প্রচুর মানুষ এখন লালগোলার বাজারে আসেন তাজা মাছের সন্ধানে। তার ফলে এই মাছের বাজারের কলেবর একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। এই বাজারের জন্য আমরা প্রত্যেকদিন পদ্মা নদীর তাজা মাছ খেতে পারছি। '