তন্ময় ভট্টাচার্য: কমিউনিস্টদের জানতে-শিখতে হবে যে, ঝান্ডার রং লাল হলে, আর তাতে কাস্তে-হাতুড়ি থাকলেই কমিউনিস্ট হওয়া যায় না। কমিউনিস্ট হওয়াটা একটা আদর্শের লড়াই, মেহনতি-বঞ্চিত মানুষের কথা তুলে ধরার লড়াই। বঞ্চিত মানুষের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করলে সে কমিউনিস্ট নাম ব্যবহার করার অযোগ্য বিবেচিত হবে। আমি মনে করি নেপাল সেটাই শেখাল। নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে এবং দুর্নীতির কাছে একটা সরকারের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণকে সাধারণ মানুষ যে বিরোধিতায় নিয়ে গেল, এটার মোকাবিলা করতে সরকার ব্যর্থ হল।
এবং এই ব্যর্থতা চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছল যখন সমস্ত সোশাল মিডিয়াকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল। অর্থাৎ, এতদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ করা যাবে না। কাজেই বাকস্বাধীনতা হরণ, বিক্ষোভের অধিকার হরণ, গণতান্ত্রিক পরিবেশ হরণ, সেটা নেপাল হোক, ভারত হোক আর আমেরিকা হোক, পৃথিবীর কোথাও যে মানুষ তা অনির্দিষ্টকাল মেনে নেয় না, নেপালের এ ঘটনায় সেটাই আবার নতুন করে সত্যে পরিণত হল। দুর্নীতির সঙ্গে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির চূড়ান্ত আপস জনগণের চোখে স্পষ্ট হতে থাকল। আর ততই নেপালের ভিতর প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল।
তবে শুধু সমাজমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞাই নয়, বিক্ষোভের নেপথ্যে আরও অনেক চাপা অসন্তোষ রয়েছে বলে মনে করি। আর ক্ষোভের অন্যতম কারণ হচ্ছে ধারাবাহিক দুর্নীতি। নেপালে ফেসবুক-সহ ২৬টি সমাজমাধ্যম নিষিদ্ধ করায় তরুণ ছাত্র-যুবদের (‘জেন জি’ ইতিমধ্যেই যাঁরা পরিচিত হয়ে গিয়েছেন) গণবিক্ষোভের জেরে ইতিমধ্যেই পতন হয়েছে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (ইউএমএল) এবং নেপালি কংগ্রেসের জোট সরকারের। বিক্ষোভকারীদের নিশানা হল পার্লামেন্টের বিরোধীপক্ষও! কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (মাওবাদী) প্রধান তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড কিংবা ‘কট্টর ওলিবিরোধী’ হিসাবে পরিচিত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঝালানাথ খনালের বাড়িও রেহাই পায়নি। পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন সেনা নেমেছে নেপালে। কোন পথে নেপালের উন্নয়ন, এই নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি কখনওই একমত ছিল না, এই জন্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বিভাজিত হয়। এবং কমিউনিস্ট পার্টির এই তিন টুকরো হওয়া, মতের সংঘাত, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড বিরোধী দলের নেতা হিসাবে পার্লামেন্টে থাকা এসব কিছু মিলে নেপালে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অস্থিরতা সুদীর্ঘকালীন।
যারা ক্ষমতায় ছিল এই কে পি শর্মা ওলি এবং নেপালি কংগ্রেস। নেপালি কংগ্রেস আগেও ক্ষমতায় ছিল, আগেও তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, দুর্নীতির সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা অনেকটাই প্রত্যক্ষ ছিল, এটা একসময়ে নেপালের গোটা কমিউনিস্ট পার্টি মনে করত। কিন্তু পরবর্তী কালে সেই নেপাল কংগ্রেসের হাত ধরেই কমিউনিস্ট পার্টির এই কে পি শর্মা ওলির গোষ্ঠী যখন সরকার গঠন করল তখন সেই দুর্নীতির মাত্রা আরও বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। নেপালের অর্থনীতি প্রধানত টুরিজম। এবং তার সঙ্গে ‘ব্ল্যাক’ অর্থনীতি হচ্ছে মাদক। এটা সবাই জানে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন এই নতুন সরকার আসার পর এই মাদকের ব্যবসা ও তার অর্থনীতি ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে যায়। সরকারি সম্পত্তির ব্যাপক নয়ছয় হতে থাকে। আর স্বাভাবিকভাবেই নেপালের শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা এসবের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কমিউনিস্ট পার্টির থেকে মানুষের যে প্রত্যাশা, তা জনগণের মেটে না। আর কমিউনিস্ট বলতে অতীতে জনগণ যেটা বুঝত সেই কমিউনিস্ট পার্টি তো নেপালে ছিল না।