উমার কৃপায় জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা, পাত্রসায়রে জমিদার বাড়ির মানত পুজো ৩০০ বছরের প্রাচীন
বর্তমান | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সংবাদদাতা, বিষ্ণুপুর: দুই লাঠিয়াল যেন জমিদারের সম্পদ। তাই তো জলদস্যুদের পরাস্ত করে জমিদারের ধনসম্পদ বাঁচিয়েছিলেন দুই বাহুবলী লাঠিয়াল দামু ও কামু। আর সেই সম্পদ দিয়েই পাত্রসায়রের হদল নারায়ণপুরে মন্দির ও পুজোর প্রচলন হয়েছিল। সেই পুজো আজও রীতি মেনে নিষ্ঠার সঙ্গে হয়ে আসছে। দুই লাঠিয়াল কিন্তু জমিদারের বিপদে পালিয়ে যাননি। সর্বশক্তি দিয়ে জলদস্যুদের তাঁরা পরাস্ত করেন। তাই আজও জমিদারবাড়ির সদস্যরা দামু ও কামুকে বীরের মর্যাদা দেন।
জমিদারবাড়ি সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় তিনশো বছর আগে মণ্ডল পরিবারের পূর্বপুরুষ বেচারাম মণ্ডল এলাকায় চাষ হওয়া নীল কলকাতায় বিক্রি করতে যেতেন। একবার ব্যবসায় প্রচুর মুনাফা হয়। প্রচুর ধন সম্পদ নিয়ে তিনি গঙ্গা দিয়ে বজরায় করে ফিরছিলেন। সেই সময় তিনি জলদস্যুদের আক্রমণের মুখে পড়েন। দস্যুদের কিছু ধনসম্পদ দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বেচারামবাবু। কিন্তু তাঁর সঙ্গে থাকা দুই লাঠিয়াল দামু ও কামু সর্বশক্তি দিয়ে দস্যুদের মোকাবিলা করেন। জলদস্যুদের পরাস্ত করে ফিরে এসে সেই লভ্যাংশ দিয়ে বেচারামবাবু মন্দির নির্মাণ করেন। তখন থেকেই এই পুজোর শুরু। পরবর্তীকালে দামু ও কামুর বীরত্বকে সম্মান জানাতে জমিদারবাড়ির সামনে তাঁদের মুর্তিও বসানো হয়।
মণ্ডলবাড়ির সদস্যরা বলেন, পুজো শুরুর অনেক আগে হদলনারায়ণপুরে জমিদারির পত্তন হয়। সেই সময় নারায়ণপুর এলাকাটি বর্ধমান রাজার অধীনে ছিল। সেই সূত্রে বর্ধমান রাজার দেওয়ান মুচিরাম ঘোষের সঙ্গে এলাকার বাসিন্দা তথা প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর রায়ের পরিচয় হয়। শুভঙ্কর রায়ের থেকে শেখা সহজ গণিতের ধারা মুচিরাম ঘোষ পরবর্তীকালে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজকে শিখিয়েছিলেন। এভাবেই তিনি মল্লরাজের বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠেন। এরপর মল্লরাজ মুচিরামকে মণ্ডল উপাধি প্রদান করেন। সেই সঙ্গে দুই গ্রাম হদল ও নারায়ণপুর সহ বেশ কিছু পরগনার জমিদারিও তিনি পান।
পাত্রসায়রের প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত জমিদারবাড়ির সিংহদুয়ার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই টেরাকোটার অপূর্ব সুন্দর রাসমঞ্চ, রথ, কালীমন্দির ও বৈঠকখানা নজরে আসবে। তারপরেই রয়েছে দুর্গামন্দির, আটচালা ও নাটমন্দির। বাড়ির পরের অংশে রয়েছে দামোদর, শিব ও লক্ষ্মীর মন্দির। দুর্গামন্দিরে রয়েছে সুদৃশ্য একটি পালকি। সপ্তমীর সকালে বাড়ির সদস্যরা ছয় রকমের বাদ্যবাজনা সহকারে পালকিতে করে বোদাই নদীর ঘাট থেকে নবপত্রিকা বরণ করে নিয়ে আসেন। দশমীর দিন একইভাবে পালকিতে করে তা নিয়ে গিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়। জমিদার বাড়ির সাবেকি প্রথা অনুযায়ী জন্মাষ্টমীর দিন দেবীমূর্তির গায়ে গঙ্গামাটির প্রলেপ পড়ে। এরপর পুজোর যাবতীয় প্রস্তুতি শুরু হয়। পুজোর ভোগে থাকে খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে তৈরি ১৪ রকমের মিষ্টি। তার সঙ্গে ৫২ পদের নাড়ু। পুরানো নিয়ম মেনে বাড়ির সদস্যরা মিলে সপ্তমীর রাতে যাত্রার আসর বসান। নবমীর রাতে জলসার আয়োজন হয়।
মণ্ডল পরিবারের বর্তমান সদস্য শৌভিক মণ্ডল বলেন, ডাকের সাজে, একচালার উপর সাবেকি প্রতিমা হয়। দেবীর মুখে গাম্ভীর্য ভাব আনা হয়। অসুরের গায়ের রং সবুজ। দ্বিতীয়ার দিন বাড়ির ছাদে নহবত শুরু হয়। তা চলে দশমী পর্যন্ত।