• নবমীতে দেবীর ভোগে চ্যাংমাছ পোড়া, পান্তা, লালগড় রাজবাড়ির সর্বমঙ্গলাই দুর্গা, তরোয়ালে বর্গি নিধন
    বর্তমান | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • প্রদীপ্ত দত্ত, ঝাড়গ্রাম: কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত বহু প্রাচীন জনপদ লালগড়। এখানে লালগড় রাজবাড়ির দুর্গাপুজো সাড়ে ৩০০ বছরের প্রাচীন। কুলদেবী সর্বমঙ্গলা এখানে দেবীদুর্গা রূপে পূজিতা হন। অষ্টমীর পুজোয় ‘সাহস রায়’ রাজাদের বর্গি নিধনের ‘ধূপ তরোয়াল’ পুজো করা হয়। নবমীর সকালে দেবীকে চ্যাংমাছ পোড়া ও পান্তাভোগ নিবেদন করা হয়।

    শাখাকুলায় লালগড় রাজাদের প্রাচীন রাজপ্রাসাদ ছিল। কালের প্রবাহে সেই প্রাসাদ কংসাবতী নদীর গর্ভে তলিয়ে গিয়েছে। পরবর্তীতে বর্তমান রাজবাড়িটি নির্মাণ করা হয়। তবে রাজবাড়িটি আজ ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে। আগের সেই জৌলুস এখন আর না থাকলেও পুজোর প্রথা ও রীতিনীতির অবশ্য কোনও বদল হয়নি। কুলদেবী সর্বমঙ্গলাকে ঘিরে এলাকায় বহু কিংবদন্তী ছড়িয়ে আছে। কথিত আছে, পুরনো রাজবাড়ির দিঘির স্বচ্ছজলে দেবীদুর্গার  দুই হাত দেখা গিয়েছিল। তৎকালীন সময়ে স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাজবাড়ির এক রানি অশুভ শক্তির বিনাশকারী দেবীর পুজোর সূচনা করেন। অষ্টমী তিথিতে কুমারীপুজোর সময় বর্গি নিধনের ‘ধূপ তরোয়াল’ পুজোর নিয়ম রয়েছে। বর্গি আক্রমণকালে নবাব আলিবর্দি খাঁর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন লালগড়ের ভূস্বামী দুই ভাই উদয় ও গুণচন্দ্র। বর্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নবাবের জয় হয়েছিল। বাংলার নবাব সেইসময় দুই ভাইকে বীরত্বের সম্মানসূচক ‘সাহসরায়’ উপাধি প্রদান করেছিলেন। পরিবারের সদস্যরা আজও বংশপরম্পরায় সেই উপাধি বহন করে চলেছেন। অষ্টমীর পুজোয় বর্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহৃত সেই তরোয়াল পুজো করা হয়। এটি ‘ধূপখাঁড়া’ নামেও পরিচিত। পরিবারের সদস্যরা জানান, ধূপ তরোয়াল লালগড় রাজবাড়ির বীরত্ব, সম্মান ও সমৃদ্ধির প্রতীক। সারা বছর ধরেই তরোয়ালটির কাছে ধূপ-ধুনো জ্বালানো হয়। সেই কারণেই পরিবারের সদস্যরা এটিকে ‘ধূপ তরোয়াল’ বলে থাকেন। রাজবাড়ির পশ্চিমদিকে রয়েছে দেওয়ালি দুর্গামন্দির। এই মন্দিরের গর্ভগৃহের দেওয়ালে চুন-সুরকি দিয়ে দুর্গাপ্রতিমা খোদাই করা রয়েছে।

    রাজ পরিবারের উত্তরসূরী অনুপ সাহসরায় বলেন, রাজবাড়ির রাধামোহন জিউর মন্দিরে কুলদেবী সর্বমঙ্গলা, কানাইলাল ও শ্রীমতি রাধিকার নিত্যপুজো হয়। দুর্গাপুজোয় কুলদেবী সর্বমঙ্গলাকে দুর্গারূপে পুজো করা হয়। সপ্তমীতে দেবীকে নিরামিষ উপাচারে ভোগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। অষ্টমীতে রীতি মেনে বর্গিদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যবহৃত তরোয়ালটিকে পুজো করা হয়। আখ, কুমড়ো ও  শসা বলি দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। নবমীর পুজোয় দেবীকে চ্যাংমাছ পোড়া ও পান্তাভোগ নিবেদন করা হয়।

    দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ লালগড় রাজবাড়ির পুজো দেখতে ছুটে আসেন। বর্তমানে লালগড় রাজবাড়ির দুর্গাপুজো ও রাধামোহন জিউর রথযাত্রাকে জেলা পর্যটনের আওতায় আনার দাবি উঠেছে। এই বছর ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির সাবিত্রী মন্দির, চিল্কিগড় রাজবাড়ির কনকদুর্গা মন্দির ও  লালগড় রাজবাড়ির পুজো দেখতে পর্যটকের ঢল নামবে বলে জেলার পর্যটন ব্যবসায়ীরা আশা প্রকাশ করছেন। যোদ্ধাভূমি লালগড় রাজাদের বহু ইতিহাস কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। রাজবাড়ির ধূপ তরোয়ালের পুজো আজও অতীতের সেই গৌরবময় দিনগুলির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।-নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)