দু’বছর আগে মেন হস্টেলে র্যাগিংয়ের জেরে ছাত্র-মৃত্যুর পরেও হাসপাতালে সেই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে হয়েছিল তাঁকে। আবার বছরখানেক আগে মেন হস্টেলেই জনৈক ছাত্রকে অন্য কয়েক জন ছাত্রের হাতে নির্যাতনের খবর পেয়ে প্রায় মধ্যরাতেই সেখানে হাজির হন তিনি। যাদবপুরের মেডিক্যাল অফিসার, প্রবীণ চিকিৎসক মিতালি দেবের দৃঢ়তার জেরেই ছেলেটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। বৃহস্পতিবার রাতে চার নম্বর গেটের কাছের ঝিলে পড়ার পরে মৃতা ছাত্রীটিকে দেখতেও তখনই হাসপাতালে যান মিতালি। শুক্রবার তিনি বলছিলেন, ‘‘আমি যখন দেখি, তখনও মেয়েটির সর্বাঙ্গ ভেজা। কিন্তু খুব বেশি ক্ষণ সে জলে ডুবে ছিল বলে মনে হয়নি।’’
চার নম্বর গেটের কাছে ঝিলটির গভীরতা সাকুল্যে পাঁচ-ছ’ফুট বলে মনে করা হচ্ছে। অতীতে ওই জলে নেমে যাদবপুরের পড়ুয়ারা দোল খেলতেন বলেও শোনা যায়। মৃতা ছাত্রী অনামিকা মণ্ডল সাঁতার জানতেন না বলে তাঁর পরিবার সূত্রের খবর। তবু নিতান্তই অগভীর ঝিলে পড়ে কেউ মারা গিয়েছেন, তা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যাদবপুরের শিক্ষকেরা অনেকেই। তবে মিতালির মতে, ‘‘কোনও ঝিল বা ডোবার উচ্চতার উপরে ডুবে মৃত্যুর বিষয়টি নির্ভর করে না। কিছু ক্ষণ নাক-মুখ জলের নীচে থাকলেই মৃত্যু হতে পারে।’’ অপঘাতে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর সঙ্গে যাদবপুরের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং ছাত্রছাত্রীদের সার্বিক ভাল থাকার সম্পর্ক উড়িয়ে দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল। ঘটনাচক্রে, এ দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকগুলি নিয়েও আলোচনায় বসে সুপ্রিম কোর্টের টাস্ক ফোর্স।
যাদবপুরের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, আধিকারিক— নানা মহলের সঙ্গে কথা বলেন টাস্ক ফোর্সের প্রতিনিধিরা। সেই বৈঠকেও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসির অধ্যাপক তথা অ্যান্টি র্যাগিং স্কোয়াডের সদস্য সন্ময় কর্মকার যেমন বৈঠকে বলেন, ‘‘আজকের দিনে ছাত্রছাত্রীদের প্রতি শিক্ষকদের দায়িত্ব আগের থেকে পাল্টেছে। পড়ুয়াদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকগুলি বোঝা জটিল হয়েছে। এর জন্য শিক্ষকদের অনেকেরই তালিম নেই। এ বিষয়ে আমাদেরও (শিক্ষকদের) পরামর্শ ও সহায়তা দরকার।’’
বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রাজ্যেশ্বর সিংহেরও মত, ‘‘যাদবপুরের সাম্প্রতিক নানা ঘটনা বা বিশৃঙ্খলার পরিপ্রেক্ষিতে কড়া প্রশাসনিক পদক্ষেপ দরকার। কিন্তু সেটাই সব নয়। শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্ক উন্নত করারও প্রয়োজন।’’ বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনার পরে তিন জন ছাত্রী প্যানিক অ্যাটাকের জেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিষয়টি নিয়ে এ দিন ইংরেজি বিভাগের অভ্যন্তরীণ বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্য খাতেও যাদবপুরের পরিকাঠামোয় নানা খামতি রয়েছে। মনোরোগ চিকিৎসক বা মনস্তত্ত্ববিদদের সপ্তাহে সাধারণত দু’-এক দিন পাওয়া যায়।
বেলঘরিয়ার নিমতার বাসিন্দা, যাদবপুরের মৃতা ছাত্রীর মা-বাবার সঙ্গে যাদবপুরের তরফে কথা বলেন ইংরেজির বিভাগীয় প্রধান শাশ্বতী হালদার এবং মেডিক্যাল অফিসার মিতালি দেব। মিতালি বলছিলেন, ‘‘ওঁরা যে মানসিক অবস্থায় ছিলেন, বেশি ক্ষণ কথা বলতে পারিনি। মেয়েটির বাবা খালি বার বার বলছিলেন, রাত ন’টা দশেও ওর (অনামিকা) সঙ্গে কথা হয়েছিল। মাত্র এক ঘণ্টায় সব শেষ হয়ে গেল।’’ অনামিকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যাদবপুরেরই এক তরুণ ছাত্রও দিনভর অন্য কাজে ছিলেন। রাতে খবর পাওয়ার পরে তিনিও গভীর মানসিক সঙ্কটে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একটি ছটফটে, হাসিখুশি প্রাণ শেষ হওয়ার ধাক্কাই যাদবপুরকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।