দুরন্ত অভিনয় আর তুখোড় সংলাপেই কামাল!বাস্তবের স্মৃতি উস্কে কেমন হল 'অচিন্ত্য আইচ'-এর দ্বিতীয় সিজন?
আজকাল | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
পর্দায় আবারও হাজির অচিন্ত্য আইচ। বাস্তবের স্মৃতি উস্কে কেমন হল সিরিজের দ্বিতীয় সিজন? লিখছেন পরমা দাশগুপ্ত।
এক কিশোরীর নৃশংস ধর্ষণ ও খুনে অভিযুক্ত বাড়িরই ড্রাইভার। দিন কাটছে ফাঁসির অপেক্ষায়। ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষোভে উত্তাল কলকাতা। রাত দখলের ডাক দিয়ে পথে নেমেছে গোটা শহর। প্লাকার্ডে-স্লোগানে একটাই দাবি, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
সদ্য মুক্তি পাওয়া সিরিজ ‘অ্যাডভোকেট অচিন্ত্য আইচ ২’-এর এই দুই দৃশ্য কিছু মনে করিয়ে দিল কি? দর্শক জানেন, দিয়েছে। প্রথমটা ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে ১৯৯০-এর সাড়া জাগানো হেতাল পারেখ ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ড এবং তার জেরে ২০০৪-এ বাড়ির নিরাপত্তা রক্ষী ধনঞ্জয় চ্যাটার্জির ফাঁসির ঘটনার দিনগুলোয়। আর পরেরটা গত বছর আরজিকর-কাণ্ডের জেরে উত্তাল কলকাতায়। যে দুটো ঘটনার স্মৃতিকে অবলীলায় এক সুতোয় গেঁথে দিল হইচইয়ের এই জনপ্রিয় অরিজিনাল সিরিজের দ্বিতীয় সিজন। এবং শেষপাতের ট্যুইস্টে আরও এক বার মাস্টার স্ট্রোক দিয়ে ছাড়লেন পরিচালক জয়দীপ মুখার্জি এবং কাহিনি-চিত্রনাট্যকার শ্রীজীব।
গল্পে বিত্তশালী চ্যাটার্জি দম্পতির (রোহিত মুখার্জি এবং রূপাঞ্জনা মিত্র) কিশোরী কন্যা দ্যুতির (অনন্যা গুহ) অর্ধনগ্ন মৃতদেহ উদ্ধার হয় বাড়িতেই। মুখোমুখি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা রাজবীরের (সোমক ঘোষ) সাক্ষ্যের ভিত্তিতে দ্যুতিকে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে ফাঁসির আদেশ হয় বাড়িরই বিশ্বস্ত ড্রাইভার রণজয় দুলে-র (সত্যম ভট্টাচার্য)। অপমানে-অভিমানে একমাত্র মেয়ে নুপূরকে (অনুমেঘা কাহালি) একলা ফেলে আত্মঘাতী হয় রণজয়ের স্ত্রী মৌমিতা। ছ’বছরের নুপূর আশ্রয় পায় তার ‘টুটুলমামা’, একই পাড়ার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট অচিন্ত্য আইচের (ঋত্বিক চক্রবর্তী) বাড়িতে। ছোট্ট নুপূর বিশ্বাস করে, তার বাবা কিছু করেনি। একরত্তি মেয়ের টুকরো টুকরো কথায় অচিন্ত্যরও ক্রমশ মনে হতে থাকে, কোথাও একটা বড়সড় গোলমাল রয়েছে, এই ঘটনায় ফাঁসানো হয়েছে নিরপরাধ রণজয়কে। অতএব সে ফাঁসির সাজায় স্থগিতাদেশ করিয়ে রণজয়ের উকিল হয়ে মামলা শুরু করে নতুন করে। বিপক্ষে দুঁদে পকসো-আইনজীবী নন্দিনী গাঙ্গুলি (সোহিনী সেনগুপ্ত) এবং অচিন্ত্যর এ হেন সিদ্ধান্তে ক্ষোভে ফেটে পড়া গোটা পাড়া। অচিন্ত্যর পাশে থাকে শুধু তার ‘ডান হাত’ ভীম (দেবরাজ ভট্টাচার্য), পুলিশকর্মী স্ত্রী (খেয়া চট্টোপাধ্যায়) এবং অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবী বাবা (দুলাল লাহিড়ী)। শেষমেশ অচিন্ত্যর সন্দেহই কি সত্যি হবে? রণজয় কি রেহাই পাবে ফাঁসির দড়ি থেকে? টানটান কোর্টরুম ড্রামায় সে উত্তর রাখা আছে গল্পের শেষে।
ঋত্বিক তাঁর প্রতিটা অভিনয়ে নিজেকেই ছাপিয়ে যেতে অভ্যস্ত। যথারীতি দুরন্ত অভিনয়ে, চোখা সংলাপে, অসামান্য কেস-ক্লোজিং স্টেটমেন্টে অচিন্ত্য আইচের থেকে তাই এক মুহূর্ত চোখ ফেরানো যায়নি। তাঁর বিপক্ষীয় আইনজীবী নন্দিনীর চরিত্রে ঠিক ততটাই জোরালো আর শক্তিশালী উপস্থিতি সোহিনীর। একই ফ্রেমে থাকাকালীন দুই বলিষ্ঠ অভিনেতা তাই কেউ কাউকে এক দূরে থাক, সিকি ইঞ্চিও জমি ছাড়েননি। মুগ্ধ হয়ে পর্দায় আটকে থেকেছে দর্শকের চোখ। অন্য দিকে, ভীমের চরিত্রে জমাটি কমিক টাইমিংয়ে দেবরাজ যখন চোখ টানেন অনায়াসে, ঠিক উল্টো পিঠে মৃত্যুর অসহায় অপেক্ষায়, স্ত্রী-মেয়ের পরিণতিতে বিধ্বস্ত রণজয় হিসেবে ততটাই মন কাড়েন সত্যম। এতটুকু বয়সে ছোট্ট নুপূরের চরিত্রে পুতুলের মতো অনুমেঘা ভারী জীবন্ত। সংক্ষিপ্ত উপস্থিতিতে, বিশেষত অ্যাকশন দৃশ্যে আলাদা করে চোখ টানেন খেয়াও। যদিও অচিন্ত্যর সঙ্গে তাঁর বিয়ে বা দু’জনের সম্পর্কটা গল্পে আরও একটু জায়গা পেলে মন্দ হত না। প্রথমে তুমুল আপত্তি সত্ত্বেও পরে ছেলের লড়াই বা নুপূরের প্রতি মায়ায় অচিন্ত্যর পাশে এসে দাঁড়ানোর সফরে নিজের স্বভাবসিদ্ধ ঢংয়েই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেন দুলাল। সোমক, রূপাঞ্জনা বা রোহিতও যে যার পরিসরে নজর কেড়ে ছাড়েন।
কোর্টরুম ড্রামা এমনিতেই রুদ্ধশ্বাস। সঠিক বুনোটের গল্পে যুক্তির মারপ্যাঁচ আর সত্যি-মিথ্যের লড়াই বরাবরই দর্শক টেনে রাখায় সিদ্ধহস্ত। তার উপরে অচিন্ত্য আইচের দ্বিতীয় কেসে শুরু থেকে শেষ টানটান রোমাঞ্চ, যাকে একেবারে শেষ মুহূর্ত অবধি ধরে রাখা গিয়েছে। কোথাও এতটুকু বাড়তি মেদ গল্পের গতিতে রেশ ফেলেনি। দ্বিতীয় সিজনও তাই দিব্যি জমজমাট।
বোঝা গেল না শুধু একটাই জিনিস। প্রথম সিজনের দুঁদে আইনজীবী সীতারাম গাঙ্গুলি(শাশ্বত চ্যাটার্জি) এমন গুরুত্বহীন, সংক্ষিপ্ততম উপস্থিতিতে পর্দায় দেখা দিলেন কেন? গল্পের রণজয়ের সত্য সন্ধানে কিংবা কেসের মীমাংসায় এমন অভিজ্ঞ উকিল বা তাঁর ভূমিকায় শাশ্বতর মতো এত বড় মাপের অভিনেতাকে কি আরও একটু কাজে লাগানো যেত না?