লজ্জা! অভিনব সমাধানে নতুন পদক্ষেপ, রেকর্ড নথিভূক্ত হবে আধার কার্ডে!...
আজকাল | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
গোপাল সাহা: শহর কলকাতা আজও এক অদ্ভুত খেলায় মেতে থাকে। সেই খেলার নাম প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগ। ছোটবেলার লুকোচুরি খেলার মতোই, বড়বেলায়ও শহরবাসী বিশ্বাস করে— “পুলিশ-পুরসভা ধরবে না, এই খেলায় জিতব আমিই।”
রোল-চাউমিনের বিলাস, আর সঙ্গে শহর নোংরা করার আনন্দ
উত্তর কলকাতার ব্যস্ত রেলস্টেশন লাগোয়া রোল কর্নার। সন্ধে নামতেই ভিড় জমে মহাষ্টমীর ঠাকুর দেখার লাইনের মতো। গরম গরম এগরোল, চাউমিন, ঝাল মরিচ। দাম ৪০, ৫৫, ৬০ টাকা সব খরচ করতে দ্বিধা নেই। কিন্তু খাওয়া শেষ হতেই গল্পের মোড় ঘোরে। কয়েক কদম দূরে এক পুরনো, জীর্ণ দেওয়ালের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন খদ্দেরেরা— রোবটের মতো একসঙ্গে ‘প্রস্রাব উৎসব’।
একজনকে থামাতে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘লজ্জা করে না?’
আমার আওয়াজ যতটা উঁচু করতে পারি, তার থেকেও জোরে উঠেছিল। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, ছেলেটির চোখে লজ্জার চিহ্ন নেই, আছে কেবল অদ্ভুত চিন্তাহীন চাহনি। যেন এটাই শহরের অলিখিত নিয়ম।
প্রশাসনের দ্বন্দ্ব: কার কাজ এটা?
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই অপরাধে কে জরিমানা করবে, তার কোনও নির্দিষ্ট নির্দেশই নেই। পুলিশ বলে, দায় পুরসভার। পুরসভা বলে, দায় পুলিশের। পুলিশ আবার বলছে, “আমাদের আরও হাজার কাজ আছে, ট্রাফিক পুলিশ করুক।”
এদিকে পাড়ার দাদারা গম্ভীর গলায় হুমকি দেন, “দায়িত্বটা একবার আমাদের দিন, তারপর দেখুন!”
ফলাফল? কিছুই নয়। শুধু দৃশ্যদূষণ আর দুর্গন্ধ বাড়তে থাকে।
অভিনব সমাধানের খোঁজ!
এক সমাজতাত্ত্বিকের মতে, এর সমাধান আছে। যেমন আছে সিবিল স্কোর, তেমনি হতে পারে সোশ্যাল ভদ্রতা স্কোর।ধরা যাক, আধার বা প্যান কার্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকল ‘প্রস্রাব রেকর্ড’। কে কত বার ধরা পড়েছন, শহরের কোথায় কোথায় নোংরা করেছন। চাকরির ইন্টারভিউতে প্রশ্নকর্তা যদি বলে ওঠেন—“আপনার বায়োডাটা তো দারুণ! কিন্তু দেখছি, গত সপ্তাহেই একবার ধরা পড়েছেন ‘প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগ’-এর জন্য। অফিসের পিছনেও কি তাই করবেন?”
ভাবুন তো, তখন কেমন ঠান্ডা ঘাম ঝরবে!
জরিমানার রহস্যময় অঙ্ক
শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা রয়েছে, ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না। করিলে ৫০ টাকা জরিমানা।’ কোথাও লেখা, ২০০ টাকা, কোথাও ১৫০০ টাকা। কোথাও আবার বিশাল কাঁচির চিহ্ন।
কিন্তু আশ্চর্য জনতা এসবের তোয়াক্কা করে না। বরং সাবধানবাণীর অক্ষর গায়েব হয়ে গিয়ে কখনও পড়ে, ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন। না করিলে জরিমানা’।
বিজ্ঞপ্তির এই বিকৃত রূপেই যেন স্বস্তি খুঁজে পায় নাগরিকেরা!
বিদেশি বিস্ময়, স্থানীয় অভ্যাস
লন্ডনে জন্মানো আমার এক আত্মীয় কলকাতায় এসে হতবাক। রাস্তায় প্লাস্টিক মোড়ক না ফেলে সে বাড়ি অবধি নিয়ে যায়। অথচ শহরের গা ঘেঁষে ‘প্লিজ ডু নট ইউরিনেট হিয়ার’ লেখা দেখে সে জিজ্ঞেস করেছিল, “এগুলো কেন ঝোলানো? পাবলিক প্লেসে মানুষ হঠাৎ এমনটা করবে কেন?”
তাঁর চোখের বিস্ময় আমি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সত্যিই প্ল্যাকার্ড ঝোলানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছি আমরাই।
আসল কথা হল, যত জরিমানা, প্ল্যাকার্ড, হুঁশিয়ারিই দেওয়া হোক, সমস্যার সমাধান হবে না যদি নাগরিক চেতনা না জাগে। শহরকে নিজের বলে ভাল না বাসলে, দেওয়াল থেকে লেখা উঠে গিয়ে যতই বলুক— “এখানে প্রস্রাব করিবেন”— আমরা হেসেই উড়িয়ে দেব।
কিন্তু যদি একদিন সত্যিই ‘ভদ্রতা স্কোর’ চালু হয়, তখন হয়তো শহরের দেওয়াল বাঁচবে, আর নাগরিকরাও শিখবে, লজ্জার জায়গায় লজ্জা করা উচিত।