পার্থ চৌধুরী: চিকু এখন ভাল আছে। কয়েকদিন আগেই জীবনমরণ সমস্যা হয়েছিল চিকুর। ভয়ংকর চন্দ্রবোড়ার কামড়ে ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ছিল। ব্লিডিং শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন চিকু সুস্থ। পরিবারের লোকের তৎপরতা আর ডাক্তারবাবুর সময় সিদ্ধান্ত বাঁচিয়ে দিয়েছে চিকুর প্রাণ। চিকু একটি ছ বছরের স্পিটজ কুকুর। এই গোত্রের কুকুরই একসময় বেশি পোষা হত ভারতে। এরা খুব ঘরোয়া আর পারিবারিক হয়। কম জায়গায় দিব্যি মানিয়ে নেয়। আবার পাহারাও দিতে পারে। একটু উনিশ-বিশ দেখলেই চিৎকার করে পাড়া মাথায় তোলে। ভালোবেসে অনেকে এই ব্রিডকে 'চিল্লানোসরাস' বলেন। এরা খুব সজাগ প্রকৃতির।
সেদিনও একটা বিপদ আঁচ করেছিল ছ-বছরের মেয়ে কুকুর চিকু। বাড়ির মেয়েটি ফ্রিজ থেকে দুধ আনতে গিয়েছিল। ঘরের কোণে ওঁত পেতে ছিল রাসেল ভাইপার। চন্দ্রবোড়া! সে সময় মেয়েটিকে বাঁচাতেই সাপের কামড় খায় চিকু। পরিবারের কর্তা রামতনু দাস বলেন, 'ও নিজের উপর নিয়ে নিয়েছে। এ বিপদ আমার মেয়েরই হতে পারত। যদিও চিকুও আমার মেয়ে। '
বাড়ি গলসীতে। দেরি করেননি রামতুন আর ইতু। বাইকে চাপিয়ে প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে চিকুকে নিয়ে আসেন বর্ধমানের ঘোড়দৌড় চটিতে। ইতু দাস জানান, পা গুলো নীল হয়ে গিয়েছিল। রক্তবমি শুরু হয়ে গিয়েছিল। পিছন থেকেও রক্ত বেরোচ্ছিল। চনমনে চিকু ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছিল। আশা কমে আসছিল। তারপরে বিশিষ্ট প্রাণী চিকিৎসক পার্থ সরকারের কয়েকদিনের চিকিৎসা। এখন সুস্থ চিকু। ফিরে গেছে বাড়ির চেনা জগতে। ডা: সরকার এর আগেও তিনটি সর্পদষ্ট কুকুরের চিকিৎসা করেছেন। অ্যান্টিভেনাম পাওয়া সহজ নয়। আরও কঠিন চন্দ্রবোড়ার কামড়ের আফটার শক। ধীরে কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যু চোখ রাঙাতে থাকে।
কিন্তু কেন?
ডা: সরকার জানাচ্ছেন, ভারতের গ্রামীণ ও আধা–শহর অঞ্চলে বর্ষাকাল এলেই সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। নদী–নালা খানা -খন্দ উপচে পড়ে, গর্তে বর্ষার জল ঢুকে যায় এবং সাপ আশ্রয় খুঁজতে মানুষের বসতবাড়ির আশেপাশে চলে আসে। এসময় শুধু গবাদি পশুই নয়, ঘরোয়া পোষা প্রাণী—বিশেষ করে কুকুর ও বিড়াল—সাপের দংশনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
সাপের প্রকারভেদ:
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ইত্যাদি জেলায় বর্ষাকালে সাধারণত দুটি ধরনের সাপ বেশি দেখা যায়—
1. নির্বিষ (Non-venomous) : ঘর চিতি, দাড়াশ, জলধড়া, লাউডগা ইত্যাদি।
2. বিষাক্ত (Venomous) : নিউরোটক্সিক – গোখরো, কেউটে, কালাচ ইত্যাদি
3. হেমোটক্সিক (Haemotoxic): চন্দ্রবোড়া বা বোড়া (রাসেল ভাইপার)।
সবচেয়ে প্রাণঘাতী এই বিষ। মজার ব্যাপার, এ সাপের ফণা নেই। তিনি জানান, এদের মধ্যে চন্দ্রবোড়ার কামড় সবচেয়ে বেশি ঘটে এবং তা বেশিরভাগই প্রাণঘাতী হতে পারে। সবচেয়ে বিপদ হয় তখন যখন বুঝতে দেরি হয়ে যায়। তিনি জানান, 'সম্প্রতি আমাদের কাছে আনা হয়েছিল “চিকু ” নামের ৬ বছর বয়সী একটি স্পিচ কুকুর (Female)। তাকে চন্দ্রবোড়া সাপে কামড় দেয় পায়ের অংশে। মালিক প্রথমে দেখেন এবং বুঝতে পারেন এটি সাপের কামড়। কারণ তিনি চন্দ্রবোড়া সাপটিকে দেখতে পান এবং ক্ষত স্থানে রক্ত ঝরা, ফোলা আর দুর্বলতা দেখেই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসেন।
কিন্তু কীভাবে প্রাণ ফিরে পেল চিকু?
রক্ত পরীক্ষায় Whole Blood Clotting Test (WBCT20) পজিটিভ আসে, যা হেমোটক্সিক বিষক্রিয়াকেই নিশ্চিত করে। চিকুর মা, বাবার দু:শ্চিন্তা বাড়তে থাকে। ততক্ষণে ক্লিনিক্যাল লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। কামড়ের স্থানে ফোলা, ব্যথা ও কালচে হওয়া। দ্রুত দুর্বলতা ও নিস্তেজ হয়ে পড়া। রক্তবমি, রক্ত-সহ পায়খানা আর একটা লক্ষণ। এসব কামড়ের গুরুতর ক্ষেত্রে Acute Kidney Injury (AKI) হতে পারে।
এরপর শুরু হয় চিকিৎসা পর্ব। অ্যান্টিস্নেক ভেনম (ASV) প্রয়োগ করা হয় নির্দিষ্ট ডোজে। এসব ক্ষেত্রে সাপোর্টিভ কেয়ার খুব গুরুত্বপূর্ণ। রোগীকে IV Fluid,PPI ড্রাগ,অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়।প্রয়োজনে ব্যথানাশক ও স্টেরয়েড। রোগীকে ৩–৫ দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয় এবং কিডনি ফাংশন বারবার পরীক্ষা করা হয়। কয়েকমাস আগে একটি ল্যাবকে গোখরো কামড়েছিল। সময়মতো অ্যান্টিভেনাম প্রয়োগ তাকে বাঁচিয়েছিল।
এক্ষেত্রেও “চিকু ” সময়মতো চিকিৎসা পাওয়ায় সুস্থ হয়ে ওঠে এবং বর্তমানে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছে। ডাক্তার পার্থ সরকার জানান, এই ধরণের কেস তারা কম পান। চিকুকে রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর দশ ভাওয়েল অ্যান্টিভেনাম প্রয়োগ করতে হয়। এক্ষেত্রে অ্যান্টিভেনাম, ওষুধের ডোজ গুরুত্বপূর্ণ। এই ফলাফল অন্য প্রাণীর চিকিৎসায় সাহায্য করবে। কুকুর মানুষের সঙ্গে আছে কম করে দশ হাজার বছর৷ আর কোনও প্রাণীর সঙ্গে মানুষের এই বন্ডিং নেই। প্রিয়জনকে বাঁচাতে নিজেকে এগিয়ে দিতে কুকুরই পারে।