ছ’জনের দেহ গ্রামে ফিরতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন আত্মীয়-পরিজনরা
বর্তমান | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বলরাম দত্তবণিক, নলহাটি: পরিবারের কর্তা বহু বছর আগে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। সংসারের হাল ধরতে অবৈধ পাথর খাদানে কাজ করতে গিয়ে একমাত্র উপার্জনকারী ছেলেরও মৃত্যু হল। অথই জলে পড়ল মৃত জিয়ারুল শেখ ওরফে লালবাবুর পরিবার। ছেলেমেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করার লক্ষ্যেই ঝুঁকি নিয়েই খাদনে কাজ করছিলেন তপন মাল। তিনি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। মৃত শ্রমিকদের পরিবারে ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে পরিবারগুলি দিশেহারা। নুন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসার কেমনভাবে চলবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
নলহাটির বাহাদুরপুর শিল্পাঞ্চলে অবৈধ খাদানে ধস নেমে পাথর চাপা পড়ে ছ’জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। মৃত জিয়ারুলের বাড়ি নলহাটির বাগানপাড়ায়। অনেক আগেই বাবা জিয়ারুলের বাবা ফিরোজ শেখ নিরুদ্দেশ হন। বাড়িতে রয়েছেন বৃদ্ধ ঠাকুমা ও মা। সংসারের হাল ধরতে পাথর খাদানে কাজে যোগ দিয়েছিলেন জিয়ারুল। একমাত্র উপার্জনশীল ছেলেকে হারিয়ে কথা বলার শক্তি হারিয়েছেন পরিবারের সকলে। মৃতের মামা মহম্মদ খাইরুল আলম বলেন, দিদির পরিবারে জিয়ারুল একমাত্র অবলম্বন ছিল। পরিবারের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে খাদানে শ্রমিকের কাজ করত। দিদি কাকে নিয়ে বাঁচবে, কীভাবে ওর দিন কাটবে জানি না।
ওই গ্রামের শ্রমিক বছর ২১-এর হজরত আলির মৃত্যু হয়েছে। বাড়িতে তাঁর তিন বছরের মেয়ে রয়েছে। প্রতিদিন কাজ সেরে মেয়ের জন্য চকোলেট বা চিপসের প্যাকেট কিনে বাড়ি ফিরতেন। শুক্রবার বিকেলেও বাবার অপেক্ষায় ছিল মেয়ে। আচমকা পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্যের মৃত্যুর খবর আসে বাড়িতে। শোকে পাথর পরিবারের লোকজন। শনিবার সাদা কাপড়ে মোড়া হজরতের দেহ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। মৃতের শ্যালক আরিফ শেখ বলেন, ভাগ্নি তিন বছর বয়সেই বাবাকে হারাল। ওদের পরিবারের কী হবে জানি না।
ছেলেমেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করে তুলতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাথর খাদানে কাজে যোগ দিয়েছিলেন পুসর গ্রামের বছর চল্লিশের তপন মাল। মেয়ে সুচিত্রা নলহাটি হীরালাল ভকত কলেজ থেকে স্নাতকস্তরের সেকেন্ড সেমেস্টারের পরীক্ষা দিচ্ছেন। ছেলে তড়িৎ মাল নলহাটি বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠে একাদশ শ্রেণিতে পরীক্ষা দিচ্ছে। শুক্রবার তপনবাবুকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় বর্ধমান মেডিক্যালে স্থানান্তরিত করা হয়। এদিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্বামীকে দেখতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্ত্রী শিখা মাল। ফোনে তিনি বলেন, ‘স্বামী ভালো নেই।’ সুচিত্রার কান্না যেন থামেই না। বলেন, সংসারে টানটানি চললেও পড়াশোনার ব্যাপারে বাবা কোনও খামতি রাখে না। এখন ভগবানই ভরসা।
একইভাবে মহুল্লা গ্রামের মৃত বছর চব্বিশের সামাউল মোল্লার উপর নির্ভরশীল ছিলেন বৃদ্ধ বাবা, মা, স্ত্রী ও এক নাবালক সন্তান। সংসারে অভাব থাকায় প্রতিবেশী শ্রমিকদের সঙ্গে তিনিও খাদানে কাজ করছিলেন। মৃতের বাবা লালচাঁদ শেখ বলেন, কীভাবে সংসার চলবে? বয়স হয়েছে, কাজ করতে পারি না। আল্লা আমার ছেলেকে রেখে আমাকে কেন নিল না?
শনিবার ময়নাতদন্তের পর গ্রামে দেহ ফিরতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন পরিবারের সদস্যরা। পাশে দাঁড়িয়েছেন এলাকার বিধায়ক রাজেন্দ্রপ্রসাদ সিং। তিনি বলেন, সকলেই দুঃস্থ পরিবারের। জেলাশাসক বিধান রায় বলেন, অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। মৃত ও জখমদের পরিবারকে খুব শীঘ্রই সরকারি ক্ষতিপূরণের টাকা পৌঁছে দেওয়া হবে।