ভবিষ্যতের দিকে নজর রেখে ফিরে যেতে হচ্ছে অতীতে। প্রায় ৮০ বছর আগেকার ঘটনাবলি আবার ফিরে আসছে চর্চায়!
বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রীর ছবি ‘দ্য বেঙ্গল ফাইল্স’-এর সূত্রে বিজেপি শিবির নতুন করে সরব হয়েছে ১৯৪৬ সাল নিয়ে। সে বছরের ১৬ অগস্ট এই শহরের বুকে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর যে ঘটনা ঘটেছিল, তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের লক্ষ্যে হৃদয় খুঁড়ে সেই বেদনা জাগিয়ে তুলতে চাইছে তারা। অগ্নিহোত্রীর ছবি অবশ্য নির্দিষ্ট বলয়ের বাইরে বৃহত্তর অংশে তেমন কল্কে পায়নি। হিন্দুত্ববাদী শিবিরের এই প্রচেষ্টার বিপরীতে সেই ১৯৪৬ সালেরই ২৯ জুলাইয়ের স্মৃতি ভাসিয়ে তুলতে চাইছে বামেরা। প্রাক্-স্বাধীনতার বছরে যে দিন নৌ-বিদ্রোহের সমর্থনে দেশ জুড়ে ধর্মঘট সাড়া ফেলে দিয়েছিল। যে ঘটনার প্রেক্ষিতে সলিল চৌধুরী গান লিখেছিলেন, ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে…’! বাম শিবিরের পাল্টা বার্তা, যদি বাংলা ও বাঙালির পরম্পরাকে স্মরণ করতে হয়, তা হলে ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম, সলিলদের সৃষ্টি মনে রাখতে হবে। ছেচল্লিশের লড়াই মাথায় রাখতে হবে, শুধু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষই ইতিহাসের শেষ কথা নয়!
দেশ এবং বিশেষত, বাংলার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই এ বার গীতিকার-সুরকার সলিল এবং পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের শতবর্য উদযাপন করতে চলেছে সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই। কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি-সহ দেশের নানা জায়গায় এই উপলক্ষে হবে নানা অনুষ্ঠান। সলিল যেমন বাঙালির আন্দোলন, সংস্কৃতি, মননের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তাঁর সুর-ছন্দের বাঁধনে, তেমনই ঋত্বিকে ছবির চোখে ধরা আছে দেশভাগের যন্ত্রণা। যাকে মোকাবিলা করেও সম্প্রীতির ঐতিহ্য ধরে রেখে এত দশক ধরে বাঙালি সমাজ এগিয়েছে। শতবর্ষ উদযাপনের অঙ্গ হিসেবে নানা জায়গায় ঋত্বিকের ছবি দেখানোর ব্যবস্থা হবে, সলিলের গান নিয়ে কনসার্ট হবে। থাকবে আলোচনা-সভা এবং আরও কিছু সাংস্কৃতিক উদ্যোগও। সলিল-কন্যা অন্তরা চৌধুরী এবং প্রয়াত সুরকারের সঙ্গে কাজ করে আসা দেবজ্যোতি মিশ্রকেও এই উদযাপনে অংশীদার করার চেষ্টা হচ্ছে।
এসএফআইয়ের সাধারণ সম্পাদক এবং সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য সৃজন ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘ইতিহাস তো একমাত্রিক নয়। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের কথা বলতে গেলে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন, নৌ-বিদ্রোহ, ধর্মঘট, তেভাগা আন্দোলন সবই বলতে হবে। সত্যকে অস্বীকার না-করেই বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস সম্প্রীতির, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির। ধর্মান্ধতার নয়। সলিল চৌধুরী ও ঋত্বিক ঘটকের শতবর্ষ আমরা সে ভাবেই স্মরণ করব।’’ শুধু ছাত্র সংগঠনই নয়, দল হিসেবে সিপিএমও নানা মঞ্চের মাধ্যমে এই উদ্যোগে শামিল হতে চলেছে। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘কেবল যান্ত্রিক ভাবে কিছু অনুষ্ঠান নয়। রাজনৈতিক চেতনার জায়গা থেকেও সুকান্ত ভট্টাচার্য, সলিল, ঋত্বিকদের স্মরণ করা জরুরি। সেই কারণেই নানা কর্মসূচি নেওয়া হবে বিভিন্ন সংগঠনের তরফে।’’
বিজেপির রাজ্য সভাপতি ও সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য বলছেন, ‘‘বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা খুব ভাল জিনিস। কিন্তু বাস্তবে কী কী ঘটেছিল, সেই ইতিহাস সামনে আসাও দরকার। ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাস চর্চার নামে প্রথমে কিছু অধ্যায় এখানে আড়াল করে দেওয়া হয়েছে। তার পরে মৌলবাদী ভাবনায় দীক্ষা এমন ভাবে হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথের ছবিতে আগুন ধরানো হচ্ছে! ব্যক্তিকে গ্রেফতার করলেই হবে না, এই ভাবনাকে কয়েদ করতে হবে!’’ শমীকের সংযোজন, ‘‘ঋত্বিক-সহ অনেক পরিচালকই দেশভাগের ছবি দেখিয়েছেন। কিন্তু সেই যন্ত্রণার কারণটা বলা হয়নি। সেটা কেউ এখন করতে চাইলে অন্যায় কোথায়?’’
এর পাশাপাশি, বলিউডের পরিচালক রাজ কপূরের জন্ম শতবর্ষও অতিক্রান্ত হতে চলেছে। সূত্রের খবর, রাজকে স্মরণে রেখেও জাতীয় স্তরে কিছু অনুষ্ঠান করতে চায় এসএফআই। রাজের বিভিন্ন ছবিতে ভারতীয়ত্বের যে বার্তা, আরএসএস-বিজেপির আগমার্কা জাতীয়তাবাদের বিপরীতে সে দিকে নজর বাম ছাত্র সংগঠনের।
অতীতের হাতিয়ার এনে বামেদের ‘মরা বন্দরে’ সলিলের লেখনীর মতো ‘জোয়ার জাগানো ঢেউ’এনে তরণী ভাসানো যাবে কি না, প্রশ্ন সেখানে।