কোনও একটি অনুষ্ঠানের আবহে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা বা গুরুতর গোলযোগ নতুন নয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাম্প্রতিক অতীতে বড়সড় অনুষ্ঠান চলার সময়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি যাদবপুরের শিক্ষাঙ্গনে বার বারই ঘটেছে। যেমন এ বছরই বিজ্ঞান শাখার ফেস্ট চলাকালীন আইসিএসই, সিবিএসই পরীক্ষা চলছে বলে ওপেন এয়ার থিয়েটারে (ওএটি) মাইক বাজিয়ে অনুষ্ঠান নিয়ে বেঁকে বসে যাদবপুরের স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার কমিটি। কিন্তু ছাত্রদের দমানো যায়নি।
শেষমেশ খোদ তৎকালীন অন্তর্বর্তী উপাচার্য ভাস্কর গুপ্তের থেকে তাঁরা মাইক বাজিয়ে অনুষ্ঠানের ছাড়পত্র আদায় করেন। মাইকের অত্যাচারে গভীর রাতেও শিক্ষাঙ্গনের আবাসনে সমস্যা হয় বলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ওই অনুষ্ঠান বন্ধ রাখার আর্জি জানিয়েছিল। তারও নিট ফল হয় শূন্য। শব্দ-বিধি শিকেয় তুলে মাঝরাত পেরিয়েও হই-হুল্লোড় চলে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ২০২৪-এর ফেস্টে শব্দদৈত্যের দাপট নিয়েও সমাজমাধমে কড়া সমালোচনার সুর শোনা গিয়েছিল। কিন্তু যাদবপুর কর্তৃপক্ষের তাতে হেলদোল দেখা যায়নি। যাদবপুর থেকেছে যাদবপুরেই।
যাদবপুরের শিক্ষকেরা অনেকেই মনে করছেন, প্রশাসনিক দুর্বলতা বা নমনীয়তাও ক্রমশ হয়ে উঠছে যাদবপুরের ছাপ্পা-মারা ঐতিহ্য। সম্প্রতি একটি ফেস্টে বহিরাগতের ভিড়ে ঠাসা শিক্ষাঙ্গনে নাভিশ্বাস ওঠে নিরাপত্তা রক্ষীদের। মদ্যপ অবস্থায় বেপরোয়া গাড়ি চালনায় আর একটু হলেই অনেকে জখম হতে পারতেন। ‘দোষীদের’ চিহ্নিত করা গেলেও কিন্তু তখন পদক্ষেপ করেননি যাদবপুর কর্তৃপক্ষ। কাউকে শাস্তিও দেওয়া হয়নি। যাদবপুরের এক শিক্ষক বলছিলেন, ‘‘এমনও হয়েছে, ছাত্রেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটিকে এড়িয়ে ইচ্ছে মতো অনুষ্ঠান করে শিক্ষকদের স্যর, পারলেন আটকাতে বলে দু’কথা শোনাতেও ছাড়েনি।’’
সম্প্রতি ঝিলে ডুবে ছাত্রী মৃত্যুর দিনও নিয়ম ভেঙে অনুষ্ঠান চলছিল অনেক রাত পর্যন্ত। কেউ কেউ বলছেন, অত রাতে মাইক বাজিয়ে অনুষ্ঠান চললে কেউ বিপদে পড়ে চেঁচালেও শোনা যায় না। ছাত্রী মৃত্যুর ঘটনাটি দুর্ঘটনা ধরে পুলিশ এগোচ্ছে। কিন্তু এর পিছনেও যাদবপুরের বেপরোয়া ছাত্রতন্ত্রের দৌরাত্ম্যের ছায়া দেখছেন অনেকেই।
মাত্র চার-পাঁচ দিন আগেও আর্টসের ইউনিয়ন রুমের সামনে নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে বচসা, অভব্যতার গুরুতর অভিযোগ সামনে আসে। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন বিজ়নেস ম্যানেজমেন্ট কোর্সের ছাত্র। তাঁরা কয়েক জন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও বন্ধুর সৌজন্যেই ইউনিয়ন রুমে দল পাকিয়ে বন্ধু, বান্ধবীরা মিলে ঢুকছেন দেখে বাধা দেন ওই রক্ষী। যাদবপুরের ইউনিয়ন রুম থেকে দূরে থাকার কথা বলেছে এসএফআই। কিন্তু হাই কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও ইউনিয়ন রুম লাগোয়া কমন রুমে ক্যারম খেলার কথা বলে যাদবপুরে ইউনিয়ন রুম বন্ধ হয়নি বলেও অভিযোগ।
যাদবপুরের রক্ষীদের অনেকের অভিযোগ, শিক্ষাঙ্গনে রোজ রাতেই কয়েকটি নির্দিষ্ট তল্লাটে মদ্যপদের তুলতে কালঘাম ছোটে। অনেকে বহিরাগত, গুটিকয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া। জনৈক শিক্ষক বলেন, ‘‘যাদবপুরের দশ শতাংশেরও কম পডুয়ার যথেচ্ছাচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। সেই সঙ্গে বড়-সড় অনুষ্ঠান হলেই কোনও না কোনও বিপজ্জনক ঘটনায় পরিকাঠামো জনিত ত্রুটি বেআব্রু হচ্ছে। ছাত্রী মৃত্যুর ঘটনায় শিক্ষা নিয়ে কড়া হাতে শৃঙ্খলা ফেরানো উচিত।’’ যাদবপুর কর্তৃপক্ষের তরফে আগামী সপ্তাহের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পক্ষকে নিয়ে বসার কথা বলা হয়েছে।