আজকাল ওয়েবডেস্ক: আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গত এক দশকে বৈশ্বিক ডানপন্থী রাজনীতি আমূল পরিবর্তিত হয়েছে। একসময় যেখানে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ও ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদই ছিল মুখ্য, এখন তা বহির্বিশ্বে নতুন মিত্র খুঁজে নিচ্ছে। বিশেষ করে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী শক্তির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অতি-ডানপন্থী আন্দোলনের যোগসূত্র দ্রুত দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এই নতুন সমীকরণ আধুনিক ফ্যাসিবাদের চরিত্রকেই পাল্টে দিচ্ছে।
এই সম্পর্ক অবশ্য একেবারে নতুন নয়। ২০ শতকের গোড়াতেই হিন্দুত্ব ও ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের মধ্যে ‘আর্য জাতি’র ধারণাকে ঘিরে একটি ভাবাদর্শগত সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে। সেই সময় বিশেষ সুবিধাভোগী উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে জার্মান জাতীয়তাবাদীদের একধরনের কৃত্রিম বংশগত যোগসূত্র দেখানো হয়। গ্রিক-ফরাসি বংশোদ্ভূত লেখিকা সাভিত্রী দেবী মুখার্জি হিন্দু মিস্টিসিজমকে নাৎসি বর্ণবাদী মতবাদের সঙ্গে মিশিয়ে এই সংযোগ আরও মজবুত করেন।
আজকের দিনে এই মৈত্রী মূলত অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে। ইসলামবিদ্বেষ, ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা এবং সংখ্যাগুরু ধর্মীয় বা জাতিগত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য—এগুলোই উভয় ধারার আন্দোলনের মিলনবিন্দু। পশ্চিমে মুসলিম সংখ্যালঘুদের সামাজিক সমস্যার মূল কারণ হিসেবে দেখানো হয়, আর ভারতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি মুসলিম, খ্রিস্টান এবং দলিত সম্প্রদায়কে নিশানা বানাচ্ছে।
এই মতাদর্শগত মিল বাস্তবে নানা সহযোগিতায় রূপ নিচ্ছে। নরওয়ের গণহত্যাকারী আন্ডার্স ব্রেইভিক তার ঘোষণাপত্রে হিন্দুত্বের প্রশংসা করেন। ডাচ ডানপন্থী নেতা গির্ট উইল্ডার্স বিজেপি নেত্রীর ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্যের পক্ষে দাঁড়ান। স্টিভ ব্যানন প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি প্রশংসা দেখান। আমেরিকার ন্যাশনাল কনসারভেটিজম কনফারেন্সের মতো অনুষ্ঠানে হিন্দুত্বপন্থী নেতারা অংশ নিয়েছেন।
আরও তাৎপর্যপূর্ণ হলো, পশ্চিমী ডানপন্থী রাজনীতিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তিত্বদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি। যুক্তরাজ্যে স্যুয়েলা ব্র্যাভারম্যান ও প্রীতি প্যাটেল, আমেরিকায় কাশ প্যাটেল ও বিবেক রামাস্বামী, জার্মানির অলিস ভাইডেলের ভারতীয় বংশোদ্ভূত সঙ্গী—সবাই মিলিতভাবে এক নতুন ধারা তৈরি করেছেন। এঁরা জাতীয়তাবাদী, ইসলামবিদ্বেষী ও অভিবাসনবিরোধী নীতি সমর্থন করে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী মহলে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দু স্বয়ংসেবক সংঘ (এইচএসএস), হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশন (এইচএএফ) ও রিপাবলিকান হিন্দু কোয়ালিশনের মতো সংগঠন নিজেদের ‘হিন্দু অধিকার’-এর রক্ষক হিসেবে তুলে ধরে বাস্তবে রক্ষণশীল ও ইসলামবিদ্বেষী নীতির পক্ষে কাজ করছে। এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে উচ্চশিক্ষায় ইতিবাচক বৈষম্য (অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন) বন্ধ করা বা কর্মক্ষেত্রে জাতপাতভিত্তিক সুরক্ষা আটকে দেওয়ার প্রচেষ্টায়।
আল্ট-রাইট প্রকাশনা সংস্থা Arktos হিন্দু মিস্টিসিজমকে ইউরোপীয় ডানপন্থী ভাবাদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে একাধিক বই প্রকাশ করেছে। সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড্যানিয়েল ফ্রিবার্গ দাবি করেছেন, তিনি ভারতে শতাধিক প্রভাবশালী নেতা ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এই সংস্থার সম্পর্ক রয়েছে ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্ট, জার্মানির ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং ইতালির লেগা নর্ড-এর মতো দলগুলির সঙ্গে।
রুশ জাতীয়তাবাদী দার্শনিক আলেকজান্ডার দুগিনকে যেমন মার্কিন ডানপন্থীরা গ্রহণ করেছে, তেমনই হিন্দুত্বপন্থীরাও তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। সম্প্রতি সুইডেনের ডানপন্থী দল Sweden Democrats এবং ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী নেটওয়ার্কের মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে। উভয় পক্ষই ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সখ্যতা বাড়াচ্ছে।
তবে এই সংযোগ মানে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ হ্রাস পাচ্ছে—তা নয়। বরং হিন্দুত্বপন্থীদের অন্তর্ভুক্তি একধরনের কৌশলগত ও শর্তাধীন ব্যবস্থা। তারা গ্রহণযোগ্য, যতক্ষণ না শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে। তাই দেখা যায়, রামাস্বামীর মতো কেউ শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের গণ্ডি ভাঙার চেষ্টা করলেই দ্রুত তাঁকে ছেঁটে ফেলা হয়।
পশ্চিমী উদারপন্থীরা যেখানে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদকে সরাসরি আক্রমণ করেন, সেখানেই হিন্দুত্ব নিয়ে প্রায়শই নীরব থাকেন। ভারতকে একটি সহনশীল ও গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে দেখার প্রবণতা এই দ্বিধার উৎস। এর ফলে হিন্দুত্ববাদ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আরও বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ডানপন্থার এই নতুন চরিত্র প্রমাণ করে যে ফ্যাসিবাদ কেবল শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি এখন হিন্দুত্বের মতো অ-ইউরোপীয় আন্দোলনের সঙ্গেও জোট বাঁধছে। ইসলামবিদ্বেষ, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু রাষ্ট্রের দাবি এবং উদার গণতন্ত্রকে আক্রমণ—সব মিলিয়ে আধুনিক ফ্যাসিবাদ নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করছে।
প্রগতিশীল শক্তিদের তাই কেবল ইউরোপ বা আমেরিকায় নয়, ভারতেও হিন্দুত্ববাদের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রান্তিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই নতুন ধরনের ফ্যাসিবাদী জোটের মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, ডানপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই কোনও একক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি এক আন্তর্জাতিক সংগ্রাম।