লৌকিক দেবী জয়চণ্ডী পূজিত হন দুর্গারূপে, একসঙ্গে পুজো করেন লোধা ও ব্রাহ্মণ
বর্তমান | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি, ঝাড়গ্ৰাম: সাঁকরাইলের ব্লকের পাথরকাটি গ্ৰামে দেবী জয়চণ্ডীই পূজিত হন দুর্গারূপে। লোধা-শবর ও ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মানুষ দেবীর পুজো করেন। ভিন ধর্মের মানুষরা স্থানীয় বাসিন্দাদের দিয়ে দেবীর পুজো দেন। লৌকিক এই দেবীকে ঘিরে নানা কাহিনি শোনা যায়।
পাথরকাটি একসময় ছিল জঙ্গলময়, হিংস্র বন্যপ্রাণীদের অবাধ বিচরণস্থল। লোধা, শবর সম্প্রদায়ের মানুষরা সেই জঙ্গলে শিকার করত। কথিত আছে, তালাই গ্ৰামের লোধা-শবরদের পূর্বপুরুষ রাম প্রামাণিক জঙ্গলে শিকার না পেয়ে করম গাছের নীচে পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সেই সময়ে দেবী জয়চণ্ডী তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেন, এই বৃক্ষের নীচে তাঁর মূর্তি রয়েছে। সেই মূর্তি তুলে পুজো করলে শিকারের অভাব হবে না। শিকারি রাম দেবীর পুজো দেওয়ার পর সাতটি বন্যপশু শিকার করেছিলেন। যে ঘটনা এলাকায় লোকগাথায় পরিণত হয়েছে। রাম প্রামাণিকের বংশধররা এখনও দেবীর পুজো করে আসছেন। বনপাটনার শতপথী জমিদাররা ১৮২০ সালে দেবী মন্দিরের তৎকালীন পুরোহিত টুকমণি লোধাকে দেবীর পুজোর জন্য ৫০ একর জমি দান করেন। বেলিয়াবেড়ার জমিদাররা ১৮৭৭ সালে পাথরকাটির জমিদারি গ্ৰহণের পর উৎকল ব্রাহ্মণদের দিয়ে মন্দিরে পুজোর সূচনা করেন। স্থানীয় লোধা-শবররা তার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। দ্বন্দ্ব মেটাতে দেবীর পুজো লোধা ও ব্রাহ্মণ একসঙ্গে করতে পারবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। প্রথা মেনে সারাবছর জয়চণ্ডীর পুজো করতেন লোধা পুরোহিতরা। ব্রাহ্মণরা পুরোহিতরা দুর্গাপুজোর চারদিন দেবীর পুজো করতেন। সেই প্রথার কোনও বদল হয়নি। বর্তমানে লোধা পুরোহিতরা মন্দিরে দেবী পুজোর সব দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন। পুজোর সময় দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা মন্দিরে পুজো দিতে আসেন। দেবীর মূর্তি ল্যাটেরাইট পাথরে খোদাই করা। আয়তকার মন্দির ইঁট দিয়ে তৈরি। মন্দিরের ভিতর উঁচু বেদিতে দেবী জয়চণ্ডীর মূর্তি। সপ্তমীর দিন লোধা-শবর পুরোহিত স্থানীয় পদ্মপুকুর থেকে ঘট নিয়ে এসে মন্দিরে পুজোর সূচনা করেন। অষ্টমী, নবমী ও দশমীতে বলি দেওয়ার প্রথা আছে। পুজোর সময় মন্দির সংলগ্ন এলাকায় মেলা বসে। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ডোম, সাঁওতাল সহ সব সম্প্রদায়ের মানুষ পুজো দিতে আসেন। মন্দিরের পূজারী দিলীপ প্রামণিক বলেন, প্রথা মেনে এবারও পুজোর আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছে। দুর্গাপুজোর সময়ে লোধা পুরোহিতরাই দেবীর পুজো করছেন। ভিন্ন ধর্মের মানুষরাও অন্যের মাধ্যমে দেবীর পুজো দেন। দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা প্রথার কোনও বদল হয়নি। সাঁকরাইলের বাসিন্দা ললিত মাহাত বলেন, দেবী খুবই জাগ্ৰত। সারাবছর ধরে মন্দিরে পুজো হয়। ভক্তরা রোগব্যাধির আরোগ্য, সন্তান কামনা, চাকরি পাওয়া, পরীক্ষায় পাশ করা থেকে নানা মনোস্কামনা নিয়ে পুজো দিতে আসেন। দেবীর মন্দিরে সবাই আসতে পারেন। চারদিন ধূমধাম করে পুজো হয়। আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষক মধুপ দে বলেন, লোধা ও ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা দীর্ঘ সময় ধরে দেবী জয়চণ্ডীর পুজো করে আসছেন। বনদেবী চণ্ডীর আর্যকৃত রূপই হচ্ছে জয়চণ্ডী। লোধা পুরোহিতরা উপবীত ধারণ করেন। এই পুজোকে ঘিরে আর্য, অনার্য ও অন্য ধর্মের মানুষের মেলবন্ধন ঘটেছে। এমন ঘটনার নজির খুব বেশি দেখা যায় না।