• ইতিহাসের পাতায় রাজতন্ত্র, আজও রাজা ছাতা তোলেন ময়দানে
    এই সময় | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • প্রশান্ত পাল, পুরুলিয়া

    রাজা-রাজড়া বা রাজ্যপাট কি ইতিহাসের পাতায় জায়গা নিয়েছে? রাজতন্ত্র বিদায় নিলেও এখনও রাজা আছেন। পরনে রাজবেশ, মাথায় উষ্ণীষ, পায়ে নাগরা। কোমরবন্ধে ঝুলছে কৃপাণ, হাতে খোলা তরবারি।

    ভাদ্র সংক্রান্তির দিনে গোধূলিবেলায় কাঁসাইপার পরগনার চাকলতোড় ছাতা–ময়দানে রাজদর্শনের জন্য ভিড় জমান হাজার হাজার মানুষ। ভিড়ে মিশে থাকে লাগোয়া ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওডিশা, এমনকী ছত্তীসগড় থেকে আসা মানুষও। ছাতা পরব উপলক্ষে ভাদ্র সংক্রান্তির দিনে রাজদর্শনের এই প্রথা আবহমানকাল ধরে চলে আসছে বাংলার প্রান্তিক এই জেলায়।

    একদিনের রাজাকে ঘিরে আজও কেন চাকলতোড়ের ছাতা-ময়দানে ভিড় জমান এত মানুষ? লোকগাথার প্রসঙ্গ টেনে পঞ্চকোট রাজবংশের উত্তরসূরি সোমেশ্বরলাল সিংহ দেও বলে ওঠেন, ‘এর সূত্রপাত কিন্তু লোকগাথা নয়, একেবারে সত্যি। অবিভক্ত মানভূমের বিস্তীর্ণ অংশ ছিল পঞ্চকোটরাজের আওতাধীন। এই রাজবংশের কমবেশি ১৯০০ বছরের ইতিহাসে নানা ঘটনা রয়েছে।’

    যোগ করেন, ‘পঞ্চকোট রাজবংশের কোনও এক রাজা যুদ্ধে যাওয়ার পরে দীর্ঘদিন তাঁর কোনও খবর রাজ্যে না–পৌঁছনোয় প্রজারা শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন। এ ভাবেই দিন পার হয়। আচমকা একদিন খবর আসে, রাজা জয়ী হয়ে ফিরে আসছেন। সেই খবরে আনন্দের বান ডেকে যায়।’

    কিন্তু রাজা যে যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরছেন, প্রজাদের কাছে সেই খবর পৌঁছবে কী করে? ঠিক হলো সাদা ছাতা উঁচু একটি দন্ডে বেঁধে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে প্রজাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। সোমেশ্বরলাল বলছেন, ‘পরবর্তীকালে পঞ্চকোট রাজ্যে এটি একটি উৎসবে পরিণত হয়। পঞ্চকোট রাজের সদরে প্রথম দিকে তা পালিত হলেও পরে রাজধানী সদর থেকে এই উৎসব কাঁসাইপার পরগনায় পঞ্চকোট রাজবংশের উত্তরসূরীদের কাছে চলে যায়।’

    এই রাজবংশের উত্তরসূরি অমিতকুমারলাল সিংহদেও প্রথা মেনে আজও রাজবেশে ছাতা-ময়দানে ছাতা তোলেন। সকাল থেকে নানা মাঙ্গলিক আচার পালনের পরে রাজবাড়ি থেকে বাজনা সহযোগে রাজা ছাতা ময়দানের উদ্দেশে রওনা দেন। সকাল থেকে রাজবাড়ি থেকে ময়দান, পথের দু’ধারে একঝলক রাজদর্শনের অপেক্ষায় থাকা মানুষ রাজার মঙ্গল কামনায় ধান-দুর্বা ছুড়ে আশীর্বাদ করেন। ঘোড়ায় চড়ে আসার প্রথা বদলে এখন হয়েছে হুডখোলা গাড়ি। প্রথা মেনে আজও রাজমহিষী তরবারি রাজার হাতে তুলে দেন।

    একদিনের রাজা হয়ে টানা ২৩ বছর ছাতা তুলছেন অমিত, ‘আমিও ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ছাতা তুলেছি। তখন আমি ক্লাশ এইটে পড়ি। বায়না ধরলাম, ঘোড়া ছাড়া যাবই না। শুরু হল ঘোড়ার খোঁজ। হঠাৎ এক ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়েই পৌঁছে যান। পরে শুনেছিলাম জয়পুর থেকে তিনি এই উৎসবে অংশ নিতে এসেছিলেন।’

    সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। মূলত জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষই শামিল হোন। ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলের জেলা পারগানা রতনলাল হাঁসদা বলেন, ‘অযোধ্যা পাহাড়ে দিশম সেন্দরা যাঁকে কেউ কেউ শিকার উৎসব বলে থাকেন, তাতে অংশ নেওয়া যেমন আমাদের সমাজের পুরুষদের কাছে গৌরবের তেমনই ছাতা পরবে শামিল হওয়া মেয়েদের কাছে সম্মানের। সাংস্কৃতিক এই উৎসবের ময়দান থেকে অনেকেই জীবনসঙ্গিনীও খুঁজে নেন. এই প্রথা চালু রয়েছে আমাদের মধ্যে. আমাদের ভাষায় যাকে বলা হয় কুঁডেল-ঞাপাম।’

  • Link to this news (এই সময়)