• বর্গি‌হানা থেকে গঙ্গাভাগ, তিন শতকের ইতিহাস আগলে রেখেছে কাশিমবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো
    প্রতিদিন | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • প্রসেনজিৎ দত্ত: ভৈরব নদের তীরে পিরোজপুর গ্রাম। সেখানেই ছিল রায় পরিবারের আদি ভিটে। ছিল সাত মহলা বাড়ি। বাঁধানো চণ্ডীমণ্ডপ। দুর্গা দালান। পুজো হত ধুমধাম করে। কিন্তু সেই ভিটেমাটির মায়া ছাড়তে হয়েছিল অযোধ্যারাম রায়কে। বর্গিদের আক্রমণে তখন ধান ফুরনো, পান ফুরনো অবস্থা। খাজনা দেওয়ারও উপায় নেই। তাদের দাপটের সামনে একে একে ধ্বংস হয়ে গেল সাধের ভিটে। সেখানে আর ফেরার কোনও উপায় ছিল না অযোধ্যারামের। বর্গি আক্রমণের অনেক আগেই, আঠারো শতকের প্রথম দিকে তিনি চলে এসেছিলেন কাশিমবাজারে। সেখানে গৃহ নির্মাণ করে দুর্গাপুজো (Gram Banglar Durga Puja) শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে উত্তরসূরি দীনবন্ধু রায়ের সঙ্গে ১৭৫৫ সালে তৈরি করেন চণ্ডীমণ্ডপ। যা এখনও বিরাজমান। সেখানেই প্রায় ৩০০ বছরের ইতিহাসকে সাক্ষী করে হয়ে আসছে দুর্গাপুজো। যতই বিপর্যয় আসুক না কেন, পুজো কিন্তু কখনও বন্ধ হয়নি।

    রায় পরিবারের পূর্বপুরুষ অযোধ্যারাম কাশিমবাজার চলে এসেছিলেন কেন? প্রশ্নটা করেছিলাম রায় পরিবারের অন্যতম উত্তরাধিকারী পল্লব রায়কে। অসাধারণ এক ইতিহাস তুলে ধরে সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে তিনি বললেন, “উনি বিচক্ষণ ছিলেন। তাই ব্যবসার কাজে চলে এসেছিলেন এখানে। তখন বিশ্বের দরবারে জমজমাট বাণিজ্যকেন্দ্র এই কাশিমবাজার। জমি উর্বর। লোকজনও খুব পরিশ্রমী। সারাবছর নানারকম শিল্পোৎপাদনে মজে থাকতেন। আশিসকুমার মণ্ডলের লেখায় আমরা পাই, সেখানে রেশম উৎপাদনের পরিমাণ ছিল বছরে বাইশ হাজার বেল (এক বেলে একশো পাউন্ড রেশম থাকে)। কাশিমবাজারের তাঁতিরা ‘তাসাতি’ বানাত। দেশের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর-সুতি বস্ত্র এখানে তৈরি হত। বাংলার রেশমের সবচেয়ে বড় সাধারণ বাজার ছিল এই কাশিমবাজার। গোটা এশিয়ায় রেশম রপ্তানি হত। মহারাজ কৃষ্ণকান্ত নন্দীর (কান্ত বাবু) উদ্যোগে সে সময় বাংলার বৃহত্তম রেশমের বাজার গড়ে উঠেছিল কাশিমবাজার এলাকা জুড়ে। নবাব আলিবর্দীর সময়ে শুরু মুর্শিদাবাদের (চুনাখালি) শুল্কচৌকির যে হিসাব পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে বার্ষিক কমপক্ষে ৭০ লক্ষ টাকার রেশম বাংলার বাইরে পাঠানো হত। দেশি-বিদেশি সকল প্রকার বণিক সম্প্রদায় এসে ভিড় করেছিলেন কাশিমবাজারে। তার আরও একটি প্রধান কারণ কাশিমবাজার বন্দরের কয়েক মাইল উত্তরেই ছিল বাংলার রাজধানী এবং নবাব সিরাজদৌলার শাসনকেন্দ্র। সুতরাং সব সময় সেনাবেষ্টিত শক্তপোক্ত প্রখর প্রহরা, এক কথায় নিরাপদ স্থান। তাই বিচক্ষণ অযোধ্যারাম রায় তাঁর বাস ও ব্যবসা স্থানান্তরিত করেছিলেন কাশিমবাজারে। রেশমের ব্যবসায় মন দিয়েছিলেন তিনি।”

    ইতিহাস শুনতে শুনতে সময়টা যেন থমকে গিয়েছিল। এই পরিবারের দুর্গাপুজোর ইতিহাস নিয়ে শুনতে গিয়ে এগুলো জানাটাও যেন বাড়তি পাওনা। মনে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক, এত বড় বন্দর কাশিমবাজার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কেন? পলাশির যুদ্ধের পর বাংলায় জাঁকিয়ে বসে ব্রিটিশরা। ১৭৮০-তে তারা কাশিমবাজারের নদীপথটি বন্ধ করে দেয়। গঙ্গা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। মুর্শিদাবাদের পাশ দিয়ে বয়ে যায় ভাগীরথী গঙ্গা এবং কাশিমবাজারের পাশ দিয়ে একটি সরু খাল, যার নাম কাঠি গঙ্গা। সময়ের পরিহাসে খাল শুকিয়ে এলে কাশিমবাজার বাণিজ্যবন্দরটিও বন্ধ হয়ে যায়, সেইসঙ্গে রায়দের ব্যবসাও। রায়বাড়ির পূর্বপুরুষ জগবন্ধু রায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর আমলেই ধীরে ধীরে কাশিমবাজার রায়বাড়ির জমিদারি বিস্তার লাভ করে। বংশ পরম্পরায় রায়বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি হয়। নতুন মহল গড়ে ওঠে। রাজবাড়ির বর্তমান যে প্রধান ফটক, নির্মিত আনুমানিক ১৮৫০ সালে। তৈরি করেছিলেন নৃসিংহপ্রসাদ রায়। ফটকের পর বাগান এবং একটি সুদৃশ্য মহলও এখন বিদ্যমান। এই মহলে আধুনিক কনফারেন্স রুম রয়েছে। পিছনে রায়বাড়ির সদস্যদের থাকার জায়গা। আধুনিকতার প্রয়োজন অনুযায়ী রায়বাড়িতে নতুন মহল গড়ে উঠেছে। ১৭৩০-এ তৈরি প্রথম মহলটি এখনও ইতিহাসের সাক্ষী। ভূমিকম্পে কিছু মহলে ক্ষতি হলেও রায়বাড়ির কোনও ক্ষতি হয়নি।

    এবার আসা যাক কাশিমবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর কথায়। কিন্তু তার আগে প্রশ্নের শেষ নেই। রাজবাড়ি কেন? নানান সমাজসেবামূলক কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ এই ‘রাজা’ উপাধি ভাইসরয় কর্তৃক প্রদত্ত। রায়বাড়ির সদস্যরা তিন পুরুষ ধরে রাজা সম্মান পেয়েছেন। ১৯৩৮-এ কমলারঞ্জন রায় রাজা উপাধি পেয়েছিলেন। পল্লববাবু জানালেন, রথের দিন কাঠামো পুজো হয়। একে বলা হয় শ্রীপাট পুজো। ওই দিনই প্রতিমায় পড়ে মাটির প্রলেপ। প্রথমে পাটপুজো, তারপর রথপুজো এবং রথটানা। তারপর মৃত্তিকার কাঠামোয় মাটি। এটাই রীতি। পুরোহিত মাটিকে মন্ত্রপূত করে পবিত্র করেন। সেই মাটি দিয়েই মৃন্ময়ী রূপ পান দেবী। বংশানুক্রমে এটাই হয়ে আসছে। অনন্ত চতুর্দশীর দিন প্রতিমায় সাদা রং করা হয়। মহালয়ার পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদে কাঠিগঙ্গা থেকে (কাশিমবাজারে এখন যাতে কাঠিগঙ্গা বলা হয়, সেটাই এক সময় বহতা গঙ্গা ছিল) জল নিয়ে আসা হয় ঘটে করে। সেই ঘট নির্মিত প্রতিমার সামনে স্থাপন করা হয়। দুর্গানাম জপ, চণ্ডীপাঠ সবই হয়। একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, এই সময় কিন্তু বেদির উপরে স্থাপিত থাকলেও দেবীপ্রতিমার পুজো হয় না। পুজো হয় বিল্ববৃক্ষ ডাল বা বেল গাছের ডাল। যা থাকে চণ্ডীমণ্ডপের এক কোনায়। এরপর বোধন, ষষ্ঠীতে আমন্ত্রণ, অধিবাস এগুলো হয়ে থাকে। সপ্তমীর দিন দ্বিতীয় বার কাঠি গঙ্গা থেকে মিছিল করে জল নিয়ে আসা হয়। কলাবউ স্থান হয়। এরপর শুরু সপ্তমী পুজো। বাকি দিনগুলোতেও প্রথা মেনে পুজো হয়। কুমারী পুজোও হয়। কাশিমবাজার রাজবাড়িতে নবরাত্রি দুর্গাপুজোর রীতি। এ বাড়ির প্রতিমা এক চালচিত্রের। সিংহের রূপ হল ‘ঘোটক সিংহ’ (সিংহ এবং ঘোড়ার মিশ্রণ)। অর্থাৎ শক্তি এবং স্ফূর্তির প্রতীক। রীতি অনুযায়ী প্রত্যেকদিন কুমারী পুজো হয়।
  • Link to this news (প্রতিদিন)