বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বোধ তৈরি হওয়ার অনেক আগেই যে লেখককে কৈশোরকাল থেকে ভালবেসে ফেলা, তিনি বোধহয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। রামের সুমতি, মেজদা, লালু, শ্রীকান্ত, মহেশের মতো কালজয়ী লেখার গভীর সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত বুঝে ওঠার বয়সে পৌঁছে অনেকের বাংলা সাহিত্য আর সারা জীবনে সে ভাবে হয়তো পড়াও হয় না। আগ্রহ, সময় বা নানা কিছুর অভাবেই। কিন্তু স্মৃতির গভীরে থেকেই যান শরৎচন্দ্র। স্বতন্ত্রতায়।
১৯১৭ সালে লেখা ‘শ্রীকান্ত’ (প্রথম পর্ব) একশো বছর পেরিয়ে এসেও আজ ‘আইকনিক’। জীবদ্দশায় বিস্ময়কর রকমের জনপ্রিয়তা অর্জন করা মানুষটির খ্যাতি আজকের মানদণ্ডে পরিমাপ করা যাবে না। যদি জনপ্রিয়তার অর্থ হয় লোকমানসে তীব্র জীবন্ত উপস্থিতি, তবে শরৎচন্দ্র ঈর্ষণীয় ভাবে আজও সমান জনপ্রিয়। তাঁর সাহিত্যকর্ম বিষয়ে নিজেই তিনি যে দিকনির্দেশ করে গিয়েছিলেন, তাই দিয়েই তাঁকে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ তিনি মূলত সামাজিক বিষয়গুলি নিয়ে দায়বদ্ধ। একটি ৩১ ভাদ্র, নিজের সাতান্নতম জন্মদিনের বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, “সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছু, যারা বঞ্চিত, যারা দুর্বল, উৎপীড়িত, মানুষ হয়েও মানুষে যাদের চোখের জলের কখনও হিসাব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনদিন ভেবেই পেলে না সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছুতেই অধিকার নেই,—এদের কাছেও কি ঋণ আমার কম? এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই পাঠালে আমাকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে।”
অকপটে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, পৃথিবীর মধুময় ফুল্লকুসুমিত যা কিছু তাঁকে অন্তরে বিচলিত করতে পারেনি, সে সব নিয়ে গল্প রচনাও তিনি করতে পারেননি। তাই বোধহয় গভীর জটিল মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণের জায়গা থেকে শরৎচন্দ্রকে নিয়ে আলোচনা খুব স্বল্পই রয়ে গেল। দুঃখজনক এই যে তাঁর অনন্য দায়বদ্ধতাকে তাঁর আবদ্ধতা হিসেবে বিচার করা হল। সমাজের ‘অপর’ বলতে যা কিছু, দলিত-প্রান্তিক-অনগ্রসর-বঞ্চিত তাঁদের কথা বলতে গিয়েই তিনি হয়ে উঠলেন নারীদের প্রতি সংবেদনশীল, অনন্য সূক্ষ্মতায় আয়না ধরলেন অনালোকিত অন্দরমহলের আনাচকানাচে।
ইতিমধ্যে পরিবার, সমাজ, রাজনীতির কাঠামো বদলে গিয়েছে, পালটে গিয়েছে সমাজে নারী-পুরুষের সমীকরণ বা অবস্থানও। তবু শরৎচন্দ্র-পাঠ প্রাসঙ্গিক। এর কারণ হল, আসলে বদল হয়েছে অবয়বের। যেমন জমিদারি ব্যবস্থার জায়গায় পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা। কিন্তু ক্ষমতা দখলের লড়াই, ক্ষমতা বা অর্থের দম্ভ বা তাকে কাজে লাগিয়ে বিবিধ নির্যাতন ও ঘটনাপ্রবাহ, ব্যক্তি মানুষের সুযোগসন্ধানী ও হীন মনোবৃত্তি— এ সব কিছুরই বদল সদর্থক হয়নি। পরিবারের একান্নবর্তীতা ভেঙে গিয়ে কাঠামো বদল হলেও ক্ষুদ্র পরিসরে কোনও বিরাট উত্তরণ হয়নি। তাই হয়তো শরৎচন্দ্রের লেখা আজও অলীক রূপকথা মনে হয় না।
শরৎচন্দ্রের লেখার বিষয়ে অমিয়ভূষণ মজুমদার বলেছিলেন, ইচ্ছাকৃত ভাবে তাঁকে শুধুমাত্র সমাজ ও নারীদরদী তকমা দিয়ে বুদ্ধিজীবী তথাকথিত ‘সিরিয়াস’ বোদ্ধা সমাজ কিঞ্চিৎ একঘরে করে রাখার চেষ্টা করেছেন। তিনি শুধু সমাজের সমস্যার দিকে আঙুল তুলেছেন, কিন্তু সমাধানের পথ দেখাননি বলে সমালোচনা করেছেন। অমিয়ভূষণের কথাতেই বলি, “অনেক বই পড়লেও কী করে বই পড়তে হয়, আমরা তা অনেকেই জানি না।” আর তাই সমস্যার সমাধান খুঁজতে উপন্যাস পড়া মানে আলো খুঁজতে আগ্নেয়গিরির কাছে যাওয়া।
শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে সময়ের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে থেকে যে শ্রেণিচেতনা, প্রেম-প্রতিবাদ ও সাম্যের স্বপ্ন আলোর মতো জ্বালিয়ে গিয়েছেন, তা কবেই একশো বছর পার করে নিজেকে চিরকালীন করে তুলেছে। যে আলোর ছটায় সমকালীন সময়েও অনায়াসে কিছু অন্ধকার মুছে নিতে পারে বৈকি!