‘বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন’! বাঙালি অধ্যাপকের পাশে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, চিঠি প্রাক্তনীদেরও
আনন্দবাজার | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
পড়ুয়াদের আন্দোলনে ‘উস্কানি’ দেওয়ার অভিযোগে প্রায় দু’বছর ধরে সাসপেনশনে থাকা বাঙালি অধ্যাপক স্নেহাশিস ভট্টাচার্যকে সম্প্রতিই বহিষ্কার করেছে দিল্লির সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়। এই সিদ্ধান্তের নিন্দা করে এ বার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখল কেন্দ্রীয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অধ্যাপকদের একটি সংগঠন। স্নেহাশিসকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে তাঁকে আবার চাকরিতে ফেরানোর দাবি জানিয়েছেন সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীরাও।
স্নেহাশিসকে বহিষ্কারের খবর প্রকাশ্যে আসার পরেই আনন্দবাজার ডট কম সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। ইমেল করে কর্তৃপক্ষের কাছে স্নেহাশিসকে বহিষ্কার করার কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তরফে স্বাতী অর্জুন উত্তর দিয়েছিলেন, “আপনাদের প্রশ্নের জবাবে জানাচ্ছি যে, শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মবিধির ৩৮.৫ ধারা অনুযায়ী স্নেহাশিস ভট্টাচার্যকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিয়োনাল কোঅপারেশন (সার্ক)-ভুক্ত দেশগুলি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষক। আগে দিল্লির চাণক্যপুরীতে ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। এখন ময়দানগঢ়হিতে। বিতর্কের সূত্রপাত ২০২২ সালে। বৃত্তির অঙ্ক বাড়ানোর দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশ পড়ুয়া। তাঁদের সেই আন্দোলন পুলিশ ডেকে তোলানোর অভিযোগ উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। সেই ঘটনার নিন্দা করে যাঁরা সরব হয়েছিলেন, তাঁদেরই এক জন ছিলেন অর্থনীতির অধ্যাপক স্নেহাশিস। পরে তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। তার পর গত বৃহস্পতিবার বহিষ্কার করা হয় তাঁকে। ঘটনাচক্রে, স্নেহাশিসের সাসপেনশনের বিষয়টি দিল্লি হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে বিচারাধীন।
বিশ্ববিদ্যাল়য়ের এই সিদ্ধান্তকে ‘প্রতিহিংসামূলক’ বলে আখ্যা দিয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে অধ্যাপকদের সংগঠন ‘ফেডারেশন অফ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিজ় টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনস’। তাদের বক্তব্য, দিল্লি হাই কোর্টে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কড়া ভাষা ভর্ৎসিত হওয়ার পরেও, তারা একাধারে অভিযোগকারী, বিচারক, জুরি এবং শাস্তিদাতার ভূমিকা পালন করছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে যে ভাবে স্বৈরতন্ত্র চলছে, স্নেহাশিসের ঘটনাই প্রমাণ বলে মনে করছে অধ্যাপকদের সংগঠন। তাদের দাবি, অবিলম্বে এই দমনমূলক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক আলোচনার পরিসর তৈরি করতে হবে।
স্নেহাশিসকে চাকরিতে ফেরানোর দাবি তুলে সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট (উপাচার্যের সমতুল্য পদ) এবং কার্যনির্বাহী পরিষদকে চিঠি লিখেছেন ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই অর্থনীতি বিভাগের ১০১ জন প্রাক্তনী। তাঁরা এখন বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। তাঁদের বক্তব্য, নিয়ম মেনে সিদ্ধান্ত নেননি কর্তৃপক্ষ। তদন্তও পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। বাকি অভিযুক্তেরা রেহাই পেলেও, আলাদা করে নিশানা করা হয়েছে স্নেহাশিসকে।
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালে প্রথমে পড়ুয়াদের আন্দোলনে পুলিশ নামানো, তার পর কয়েক জন পড়ুয়াকে বহিষ্কার করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় প্রথমে স্নেহাশিস-সহ পাঁচ জনকে শো কজ় করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, পাঁচ জনের মধ্যে চার জন শো কজ়ের জবাব দেন। তা খতিয়ে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি’ (তথ্যানুন্ধানকারী দল) গঠন করেছিলেন। ওই কমিটি অভিযুক্ত অধ্যাপকদের তলব করে। শুধু তা-ই নয়, সেখানে বসে একগুচ্ছ প্রশ্নের লিখিত জবাবও দিতে বলা হয়। বিষয়টি ‘অবমাননাকর’ বলে জানিয়ে তাতে রাজি হননি স্নেহাশিসেরা। তাঁরা জানান, কমিটি তাঁদের ইমেল করলে, সেখানে তাঁরা যাবতীয় প্রশ্নের জবাব দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হননি।
এর পর ২০২৩ সালের জুন মাসে স্নেহাশিস-সহ চার অধ্যাপককে সাসপেন্ড করে বিশ্ববিদ্যালয়। এর বিরুদ্ধে দিল্লি হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন অধ্যাপকেরা। আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন পড়ুয়ারাও। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে পড়ুয়াদের মামলার রায় দেয় আদালত। তাতে কর্তৃপক্ষকে কড়া ভাষায় ভর্ৎসনা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্রের দাবি, কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপের নিন্দা করে অধ্যাপকেরা চিঠিতে যা লিখেছিলেন, সেই একই বক্তব্যই আরও ‘জোরালো’ ভাবে বলেছিল উচ্চ আদালত।
পড়ুয়াদের মামলার মীমাংসা হলেও, স্নেহাশিসদের সাসপেনশন-মামলার প্রেক্ষিতে দিল্লি হাই কোর্টের একক বেঞ্চ জানায়, তাদের এই মামলা শোনার এক্তিয়ার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও আদালতে জানান, আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার সুবাদে কেন্দ্র তাদের রক্ষাকবচ দিয়েছে। সেই কারণেই তাঁদের বিরুদ্ধে এই ধরনের মামলা শোনা যায় না।
উচ্চ আদালতের ওই পর্যবেক্ষণের পরেই চার অধ্যাপককে ডেকে পাঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট। তাঁদের কয়েকটি শর্ত দেওয়া হয়। বলা হয়, ‘ক্ষমা’ চাইতে হবে। আর ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা যাবে না। অভিযুক্ত চার অধ্যাপকের মধ্যে এক জন অস্থায়ী ছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরেই ইরফানুল্লা ফারুকি নামে ওই অধ্যাপকের স্থায়ীকরণের প্রক্রিয়া চলছিল। কিন্তু সাসপেনশনে থাকার ফলে বেশ কিছু নথি জমা দিতে না পারায় তাঁকে আর স্থায়ী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ করেননি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শর্তে বলা হয়েছিল, এই বিষয়টি নিয়েও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। তেমনই খবর বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে।
কর্তৃপক্ষের এই তিন শর্ত মেনে নিয়েছিলেন চার অধ্যাপকের মধ্যে দু’জন। তাঁরা ক্ষমা চেয়ে চাকরিও ফিরে পান। কিন্তু স্নেহাশিস রাজি হননি। এর পরেই হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হন। আদালতে তাঁর বক্তব্য, তিনি কোনও ‘দোষ’ করেননি। যা করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির কথা ভেবেই করেছেন। নাগরিক হিসাবে তাঁর যেমন আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার অধিকার রয়েছে, তেমনই বিশ্ববিদ্যালয়ও তাঁকে নিজের মতামত পেশ করার অধিকার দিয়েছে। নিজের এক্তিয়ারের মধ্যে থেকেই যা করার করেছেন তিনি।
ডিভিশন বেঞ্চে স্নেহাশিসের মামলার পরেই একটি শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি গঠন করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ঘটনাচক্রে, বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি স্নেহাশিসের বিরুদ্ধে ৫২টি অভিযোগ তুলেছিলেন, সেই প্রক্টরও ছিলেন ওই শৃঙ্খলারক্ষা কমিটিতে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে কমিটি স্নেহাশিসকে ডেকে পাঠিয়েছিল। পরে তারা একটি রিপোর্টও জমা দেয়। এর পরেই ১৮ অগস্ট শো কজ় করা হয় স্নেহাশিসকে। জানতে চাওয়া হয়, কেন তাঁকে বহিষ্কার করা হবে না। কিন্তু অভিযোগ, কমিটির রিপোর্ট তাঁর কাছে না পাঠিয়েই অধ্যাপককে শো কজ় করা হয়েছিল। বার বার চেয়ে পাঠানোর পর অবশ্য ওই রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল স্নেহাশিসকে। সূত্রের দাবি, ওই রিপোর্টে অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ওঠা মোট ৫২টি অভিযোগের তলায় তাঁর উত্তর পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লিপিবদ্ধ ছিল। শেষে একটিই বাক্য— ‘দ্য চার্জ স্ট্যান্ডস প্রুভড’। বাংলা তর্জমা করলে হয়, ‘অতএব, অভিযোগ প্রমাণিত।’ কিন্তু আর কোনও ব্যাখ্যা শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, গত ৩০ অগস্ট স্নেহাশিস শো কজ়ের জবাব দিয়েছিলেন। এর পর বৃহস্পতিবার তিনি বহিষ্কারের চিঠি হাতে পান।
কিন্তু স্নেহাশিসের মামলা এখনও ডিভিশন বেঞ্চে রয়েছে। আগামী মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর মামলার শুনানি রয়েছে। আপাতত সে দিকেই তাকিয়ে অধ্যাপক। প্রসঙ্গত, স্নেহাশিস আশুতোষ কলেজের ছাত্র। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমেরিকার নটরডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন। ২০১০ সালে পিএইচডি শেষ করেন। ২০১১ সালে সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন তিনি।