• চিকিৎসার পাশাপাশি সমাজের মানবতার আলোর দিশারী কিংবদন্তি ‘গরিবের ডাক্তার’ যোগেন সরকার...
    আজকাল | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • গোপাল সাহা

    পেশায় তিনি চিকিৎসক, কিন্তু নেশায় লেখক। জীবনের অর্ধশতক সময় কাটিয়ে দেওয়া এই মানুষটির নাম চিকিৎসক যোগেন সরকার। যিনি পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামীণ জনপদে আজ এক কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন। সাধারণ মানুষ তাঁকে চেনেন ‘গরিবের ডাক্তার’ নামে। চিকিৎসা তাঁর পেশা হলেও মানবসেবা আর সাহিত্যচর্চাই যেন তাঁর জীবনের মূল উদ্দেশ্য, যেন দু’টি একই সুরে গাঁথা।

    চিকিৎসকের পথচলা

    ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন যোগেন। ডাক্তারির পড়াশোনা শেষ করে তাঁর সামনে খুলে গিয়েছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দরজা। কলকাতার নামী বেসরকারি হাসপাতালে চাকরির সুযোগও এসেছিল। কিন্তু তিনি সেই দিকে ফিরেও তাকালেন না। কারণ, তাঁর মন পড়ে ছিল গ্রামে— সেই সব অসহায় গরিব মানুষদের জন্য ভেবেছিলেন তিনি, যাঁরা চিকিৎসার অভাবে নীরবে কষ্ট পাচ্ছিলেন।

    সরকারি হাসপাতালে প্রায় ২৯ বছর ধরে নিরলস সেবা করেছেন তিনি। এরপর অবসরে গিয়েও থেমে থাকেননি। বাড়িতে বসে আবার চিকিৎসা শুরু করলেন। নামমাত্র ফি নিতেন, আবার অনেক সময় কোনও ফি নিতেনই না। তাঁর মতে, “চিকিৎসা ব্যবস্থা কোনও ব্যবসা নয়, এটা দায়িত্ব। যে অসহায় মানুষ ওষুধ কিনতেই হিমশিম খায়, তাঁর কাছ থেকে টাকা নেওয়া অন্যায়।”

    আজও তিনি প্রতিদিন সকালে উঠেই রোগীদের খোঁজখবর নেন। দীর্ঘ ৪৫ বছরের অভিজ্ঞতার জন্য গ্রামীণ মানুষেরা তাঁকে প্রায় ভগবানের আসনে বসিয়েছেন।

    চিকিৎসক যোগেন বাবুর সাহিত্যচর্চার নেশা

    ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি যোগেন বাবু একজন নিষ্ঠাবান লেখকও। রোগীর সেবা শেষে যখন অন্যরা বিশ্রাম নেন, তখন তিনি কলম হাতে তুলে নেন। রাতভর চলে লেখা। তাঁর খাতায় জমা হয়েছে অসংখ্য উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা আর গান। অনেক বই ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে, আবার কিছু বই প্রকাশের অপেক্ষায়।

    তিনি বিশ্বাস করেন, লেখা হল মানুষের আত্মার কণ্ঠস্বর। চিকিৎসা যেমন শরীর বাঁচায়, লেখা তেমনি মানুষের মনকে ছুঁয়ে যায়।

    চিকিৎসকের সামাজিক দায়িত্ববোধ

    যোগেন বাবু শুধু চিকিৎসক বা লেখক নন, একজন সক্রিয় সমাজকর্মীও। তিনি একাধিক ক্লাবের সভাপতি হিসেবে কাজ করছেন। গড়ে তুলেছেন একটি আশ্রম, যেখানে অসহায় মানুষ আশ্রয় পান। তাঁর ইচ্ছা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সমাজের পাশে থাকা।

    নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে তিনি হেসে বলেন, “আমার কোনও আক্ষেপ নেই। শহরের চাকচিক্য ছেড়ে গ্রামের মানুষকে বেছে নিয়েছিলাম। বিনিময়ে পেয়েছি তাঁদের অশেষ ভালোবাসা। এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।”

    ডাক্তার যোগেন বাবু যেন প্রেরণার প্রতীক। জীবনের গল্প কেবল একটি ব্যক্তির কাহিনি নয়, এটি মানবতার পাঠশালা। তিনি প্রমাণ করেছেন, সত্যিকারের চিকিৎসক কেবল অসুখ সারান না, মানুষের ভরসাও হয়ে ওঠেন। আবার একজন লেখক কেবল শব্দ লেখেন না, মানুষের হৃদয়ে আলো জ্বালান।

    আজকের দিনে যখন চিকিৎসা অনেক সময় ব্যবসায়িক স্বার্থে যখন আবদ্ধ হয়ে পরে, তখন যোগেন বাবুর জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেবা আর মানবতা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। যা প্রতি মুহূর্তে প্রমাণ করেছেন চিকিৎসক যোগেন সরকার।
  • Link to this news (আজকাল)