• কেন্দ্রের বঞ্চনা, জল জীবন প্রকল্পে বকেয়া ৭ হাজার কোটি
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • জল জীবন মিশন প্রকল্পে কেন্দ্র ও রাজ্য সমান সমান অর্থ বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই রাজ্যে ভোট প্রচারে এসে ফলাও করে ঘরে ঘরে জল পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষকে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে কোনও সদিচ্ছা চোখে পড়েনি কেন্দ্রের সরকারের।

    জল জীবন মিশন প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের অর্ধেক টাকা দিয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছে কেন্দ্রীয় জল শক্তি উন্নয়ন মন্ত্রক। একশো দিনের কাজ, সর্বশিক্ষা অভিযান, আবাস যোজনার পর ফের কেন্দ্রের বঞ্চনায় সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে বাংলার এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার ঠিকাদার, মিস্ত্রি, কর্মী এবং সাপ্লায়াররা। প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা বকেয়ার দাবিতে রাজধানীর রাস্তায় আন্দোলন কর্মসূচি করার পরিকল্পনা করছে রাজ্যের ঠিকাদার সংগঠনগুলি।

    ‘হর ঘর জল’ স্লোগান সামনে রেখে নরেন্দ্র মোদীর সরকার চালু করেছিল জল জীবন মিশন প্রকল্প। ২০১৯-এর স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে দেশের প্রতিটি বাড়িতে স্বচ্ছ পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেই লক্ষ্যে কেন্দ্র ও রাজ্য–দুই সরকার প্রকল্পের ব্যয়ভার সমানভাবে বহন করার কথা ঘোষণা করে। কোভিডের কারণে প্রকল্প পিছিয়ে পড়লেও ২০২১ থেকে আবার প্রকল্পের কাজ এগোতে থাকে।

    এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে যাঁরা প্রাণপাত পরিশ্রম করেছেন, সেই ঠিকাদাররাই গত এক বছর ধরে চরম আর্থিক সমস্যা ভোগ করে চলেছেন। গত বছর পুজোর পর থেকে এই প্রকল্পে কাজের জন্য কোনও অর্থই পাননি তাঁরা। এখনও পর্যন্ত বকেয়ার পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর পাশাপাশি যে কাজের বিল এখনও তৈরি হয়নি, তার পরিমাণ আরও প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত প্রায় ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের ঠিকাদারদের বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন চলাকালীন বুথে অস্থায়ী শৌচালয়, পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে গিয়ে রাজ্যের কাছে বকেয়া ৩২৫ কোটি।

    ঠিকাদারদের সংগঠন অল বেঙ্গল পিএইচই কন্ট্রাকটার্স অ্যাসোসিয়েশন এর আগে জেলা স্তরের সরকারি আধিকারিকদের কাছে একাধিকবার দরবার করেছে বকেয়া টাকা পেতে। ফল না মেলায় এরপর একে একে রাজ্যের জনস্বাস্থ্য কারিগরী মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রীকে চিঠি লিখে সমস্যার কথাও জানিয়েছে। পুজোর মুখে এবার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নিজেদের আবেদন পৌঁছে দিতে চাইছে ঠিকাদারদের সংগঠন। সংস্থার অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক মানস চট্টোপাধ্যায় এক সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী অনেক ক্ষেত্রে মানবিক পদক্ষেপ করেছেন। কিন্তু আমরা নানাভাবে চেষ্টা করেও তাঁর কাছে নিজেদের আর্জি পৌঁছে দিতে পারছি না। আশা করি ওঁর কাছে এই খবর পৌঁছলে তিনি কিছু ব্যবস্থা করবেন।’

    বকেয়া অর্থ পাওয়ার আশায় পুজোর মুখে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন রাখার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে সংগঠনের তরফে। সংগঠন সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদনের পাশাপাশি, জেলাস্তরে আন্দোলন হবে। দীপাবলির পর দিল্লিতে এসে আন্দোলন করার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। মন্ত্রীকে চিঠি লিখে সময় চাওয়া, মন্ত্রক বা যন্তর মন্তরে ধরনা দেওয়া, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে সমস্যার কথা জানানো এবং স্মারকলিপি দেওয়া–এই ধরনের নানা কর্মসূচির পরিকল্পনা রয়েছে।

    জল জীবন মিশন প্রকল্পে ২০২৪-এর মধ্যে প্রত্যেক ঘরে ঘরে স্বচ্ছ, পরিশুদ্ধ পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। লক্ষ্যমাত্রার থেকে এখনও অনেকটাই দূরে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় সাড়ে ১৯ কোটি গ্রামীণ পরিবারের মধ্যে সাড়ে ৩ কোটির বেশি বাড়িতে এখনও পৌঁছে দেওয়া যায়নি জলের কল। এরই মধ্যে এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদাররা যেভাবে কেন্দ্রীয় বঞ্চনায় সম্মুখীন হচ্ছেন, তাতে তাঁদের কাজে অনীহা দেখা দেবে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আরও সময় লেগে যাবে তা বলাই বাহুল্য।

    ঠিকাদার সংস্থার অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক মানসবাবুর বক্তব্য, ‘বকেয়া থাকা এই কোটি কোটি টাকা শুধু আমাদের টাকা নয়। বিভিন্ন মহাজন, সাপ্লায়ারদের টাকা। মিস্ত্রি, কর্মীরা কাজ করেছে, তাঁদের টাকা। সব মিলিয়ে কয়েক হাজার মানুষের পরিশ্রম এর সঙ্গে জড়িয়ে। ভাবুন, উৎসবের মরশুমে সবার আনন্দ, আমাদের কী পরিস্থিতি ?’

    প্রসঙ্গত, এর আগেও আগস্ট মাসে বকেয়া টাকার দাবিতে কেন্দ্রীয় জল সম্পদ মন্ত্রী সিআর পাতিলের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল তৃণমূলের ১৬ জন সাংসদের। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হয়, গোটা রাজ্যে জল জীবন মিশনে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে মোট বরাদ্দ ছিল ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকা। তার মধ্যে কেন্দ্রের বরাদ্দ ৫ হাজার ৫০ কোটি। তার মধ্যে কেন্দ্র দিয়েছে ২ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা, অর্থাৎ অর্ধেক। অথচ রাজ্য তার বরাদ্দের ৩০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে দিয়েছে, যার কাজ ইতিমধ্যেই সমাপ্ত। পাশাপাশি ২৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে। তুলে ধরা হয়, রাজ্যের যেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ৪ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা এই প্রকল্পে দেওয়ার কথা ছিল, সেখানে রাজ্য সরকার ৪ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছে জল জীবন মিশন প্রকল্পে।

    রাজ্যের তরফে ৫০ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করার কথা থাকলেও রাজ্যের মানুষের স্বার্থে জমি, রক্ষণাবেক্ষণ থেকে আনুসঙ্গিক সব খরচ নিজেদের কাঁধেই বহন করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষেই কেন্দ্রের বরাদ্দের থেকে ২ হাজার ৪০১ কোটি টাকা বেশি দিয়েছে রাজ্য। তারপরেও ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে এসে কেন্দ্র তাদের বকেয়া দিচ্ছে না।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)