• বুথ-লেভেল অফিসারদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ...
    আজকাল | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিহারের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা নিয়ে তীব্র বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বুথ-লেভেল অফিসাররা (BLO) নির্বিচারে নাম মুছে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একাধিক বুথ পর্যালোচনা ও BLO সাক্ষাৎকারে দেখা গেছে, ভোটারদের বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নীতি বা প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। এর ফলে লাখ লাখ মানুষ ভোটাধিকার হারানোর আশঙ্কায় পড়েছেন।

    পূর্ব বর্ধমান থেকে ৪০ বছর আগে বিহারে আসা ঝুরনা দাসের নাম হঠাৎই ভোটার তালিকা থেকে উধাও। পুরনিয়ার উপকণ্ঠের বেলৌরি গ্রামে বসবাসকারী ঝুরনা শেষবারের রাজ্য নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু এবার খসড়া ভোটার তালিকায় তাঁর নাম নেই। অথচ বাদ পড়া ভোটারদের তালিকাতেও তাঁর নাম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভোটার পরিচয়পত্র নম্বর প্রবেশ করালে বারবার দেখা যাচ্ছে— No Result Found।

    স্থানীয় BLO তাঁকে জানিয়েছেন, আবার নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হলে মৃত বাবা-মায়ের নথি জমা দিতে হবে। অথচ নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকা অনুযায়ী, ১৯৮৭ সালের আগে জন্ম নেওয়া ভোটারদের নাগরিকত্ব প্রমাণে বাবা-মায়ের কাগজপত্রের প্রয়োজন নেই। পুরনিয়ার নির্বাচনী রেজিস্ট্রেশন অফিসার পার্থ গুপ্তও স্বীকার করেছেন, ঝুরনার ক্ষেত্রে BLO'র এই দাবি অযৌক্তিক।

    নির্বাচন কমিশনের Special Intensive Revision প্রক্রিয়ায় প্রকাশিত খসড়া ভোটার তালিকা থেকে ৬৫ লক্ষ ভোটার বাদ গিয়েছেন। আমাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২৬ জেলার ৫৮টি আসনের ২০০ বুথে গড়ে এক-তৃতীয়াংশ ভোটারকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও অর্ধেক ভোটারও মুছে ফেলা হয়েছে। এই ২০০ বুথে মোট ৭৭,৪৫৪ জন ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী, যদি কোনো বুথে দুই শতাংশের বেশি নাম বাদ দেওয়া হয়, তবে তৃণমূল স্তরে অতিরিক্ত যাচাই প্রক্রিয়া চালানোর কথা। বাস্তবে কিন্তু এই নির্দেশিকা কার্যত মানা হয়নি।

    পুরনিয়ার নির্বাচনী রেজিস্ট্রেশন অফিসার পার্থ গুপ্ত স্বীকার করেছেন, BLO-দের প্রশিক্ষণে লিখিত বা সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়নি। তাঁদের বলা হয়েছিল, মৃত্যুর শংসাপত্র থাকলে ভালো, না থাকলে স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করলেও চলবে। তাঁর ভাষায়, “ব্যক্তিগত সন্তুষ্টিই যথেষ্ট।”ফলে একেকজন BLO একেক রকম মানদণ্ডে কাজ করেছেন। কেউ প্রতিবেশীর কথায় বিশ্বাস করেছেন, কেউ আবার নিজের পরিবারের সদস্যদের দিয়ে যাচাই করিয়েছেন। কয়েকজন অবশ্য মৃত্যু শংসাপত্র বা লিখিত ঘোষণার নথি রেখেছেন নিজেদের সুরক্ষার জন্য।

    মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যাঁদের নাম বাদ পড়েছে তাঁদের অনেকেই বহু বছর ধরে একই ঠিকানায় বসবাস করছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের “absent” বা “shifted” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ অনেক ভোটারই দাবি করেছেন, ব্লোরা তাঁদের বাড়িতে কোনোদিনই যাননি। পাটনার বাসিন্দা  দিঘার গৃহকর্মী জুমাইরা খাতুনের ছেলে লালন মুম্বাইয়ে কাজ করেন। প্রতি বছর দু-তিনবার বাড়ি ফেরেন। গত লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে ভোটও দিয়েছেন। তবুও এবার তাঁকে “absent” বলে বাদ দেওয়া হয়েছে। খাতুন বলেন, “আমার ছেলে এখানেই জন্মেছে। এখন আবার নথি জোগাড় করতে হবে, কিন্তু আমরা অশিক্ষিত মানুষ, কীভাবে করব?”

    হাজিপুরের বাগমারির উপেন্দ্র পণ্ডিত ও তাঁর স্ত্রী প্রেম শীলা দেবীর নামও মুছে ফেলা হয়েছে। দু’জনকে আলাদা কারণে—একজনকে “shifted”, অন্যজনকে “absent” বলে বাদ দেওয়া হয়েছে। পেশায় ঠেলাগাড়ি চালক উপেন্দ্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা কোথাও যাইনি। অথচ এখন ভোট দিতে পারব না।” ১৭ জন বিএলও'র  সাক্ষাৎকারে জানা গেছে, প্রত্যেককে পাঁচ-ছ’টি প্রশিক্ষণ শিবিরে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে কেবল মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কোনো লিখিত দিশানির্দেশ দেওয়া হয়নি। ফলে কারও কাজের ধরন নথিপত্র নির্ভর, কারও আবার পুরোপুরি ব্যক্তিগত ধারণা বা গুজব নির্ভর।

    প্রত্যেক বিএলও-কে একটি মোবাইল অ্যাপে তথ্য আপলোড করতে বলা হয়েছিল। যাঁরা ফর্ম জমা দেননি বা পর্যাপ্ত নথি দেখাতে পারেননি, তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও নথি জোগাড়ের অক্ষমতার কারণে হাজার হাজার ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। বিহারের Special Intensive Revision প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। নির্বাচন কমিশন সেপ্টেম্বর ১ তারিখ পর্যন্ত দাবি-আপত্তি জানাতে বলেছিল, পরে সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের মতে, গরিব ও প্রান্তিক মানুষের পক্ষে এই জটিল প্রক্রিয়ায় নিজেদের নাম ফিরিয়ে আনা কার্যত অসম্ভব। ফলে আসন্ন নির্বাচনে তাঁদের ভোটাধিকার খর্ব হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
  • Link to this news (আজকাল)