• পঞ্চকোট রাজবংশের দেবীবাড়ির দুর্গাপুজো
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • পুরুলিয়ার কাশিপুরে পঞ্চকোট রাজবংশের দেবীবাড়িতে সোমবার থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে দুর্গাপুজো। রাজবাড়ি থেকে অনতিদূরে দেবীবাড়িতে প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে জীতাষ্টমীর পরের দিন কৃষ্ণা নবমী থেকেই শ্রীশ্রীরাজরাজেশ্বরী মন্দিরে দেবী পুজো শুরু হয়। কাশিপুরের এই দেবীবাড়িতে টানা ১৬ দিন ধরে ষোড়শপচারে দেবী দুর্গার আরাধনা হয়। প্রায় দুহাজার বছরেরও বেশী প্রাচীন এই পুজোয় আজও সমান গুরুত্ব সহকারে মানা হয় পরম্পরাগত রীতি রেওয়াজ। মন্দির সূত্রে জানা গিয়েছে, এদিন ছাগ বলি হয়। নিয়ম মেনে পূজার্চনার পর এখনও হয় আগমনীর গান। পুজো শেষে নিয়ম মাফিক হয় পাঠা বলি। ভাত, ডাল, নয় রকম ভাজা, মাছ, পাঠার মাংস সাজিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয়।

    এই পুজোর ইতিহাস সম্পর্কে পঞ্চকোট রাজ পরিবারের উত্তরসূরী সোমেশ্বরলাল সিং দেও বলেন, ‘আমার মনে হয় পঞ্চকোট রাজবংশের এই দুর্গাপুজো এই তল্লাটের তথা জঙ্গলমহলের সর্ব প্রাচীন পুজো। দামোদর শেখর সিং দেও এখানে জন্মগ্রহণ করেন এবং পরবর্তীকালে চাকলা পঞ্চকোট নামে রাজত্ব স্থাপন করেছিলেন। তখন থেকে এখানে দুর্গাপুজো হচ্ছে। তবে সে সময় ঘট ও যন্ত্রে পুজো হত। তাঁর রাজত্ব কালে অষ্টধাতু দিয়ে নির্মিত চতুর্ভুজা ত্রিগুনা মূর্তি রাজরাজেশ্বরী দেবী শিখরবাসিনীর আরাধনা শুরু করেন তিনি। এই রাজরাজেশ্বরী মা হচ্ছেন কল্যানেশ্বরীর প্রতি মূর্তি। মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষণে আজও দেবীর কাছে রাখা সিঁদুরে ছাপ পড়ে দেবীর পদ যুগলের।’

    বংশ পরম্পরায় ৮০ পুরুষ ধরে পৌরহিত্য করে আসছেন গৌতম চক্রবর্তী। তিনি জানান, ‘তৎকালীন রাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিং দেও আমার ঠাকুরদার বাবা পণ্ডিত রাখাল চন্দ্র বিদ্যারত্ন কে পৌরহিত্য করার জন্য নিয়ে আসেন। বর্তমানে আমি পৌরোহিত্য করি। আমি ৮০ তম পুরোহিত।’ তাঁর কথায়, রাজরাজেশ্বরী মন্দিরের দেবী প্রতিষ্ঠিত। বাইরে থেকে কোনও মূর্তি আনতে হয় না। তাই এখানের পুজোয় বেল্লীবরন নেই।

    ষোড়শপচারে পুজো হলেও এখানের দেবী মূর্তির রয়েছে বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য। কাশিপুরে এই দেবীবাড়িতে অষ্ট ধাতুর চতুর্ভুজা দেবীর আরাধনা করা হয়। এখানে দুর্গাপুজোর সপ্তমীর রাত্রে দেবীকে নীচে নামানো হয়, তারপর অলংকার দিয়ে শৃঙ্গার করানো হয়। রীতি অনুযায়ী এখনও দেবীকে তুষ্ট করার জন্য আগমনী গান সহ নৃত্য ও গানবাজনার আসর বসে। এখানকার পুজোর বিশেষত্ব হল মহাষ্টমীর দিন এখানে এক বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়, যাকে শ্রীনাথ মন্ত্র বলা হয়। পণ্ডিত রাখাল চন্দ্র বিদ্যারত্ন এই শ্রীনাথ মন্ত্র লিপিবদ্ধ করে যান। গৌতমবাবু জানিয়েছেন, ওই মন্ত্র কোনও কপিরাইট হয় না, মুখস্থ করে বলতে হয়।

    সোমবার কৃষ্ণা নবমীর দিন পুজো দেখতে এলাকার বহু মানুষ উপস্থিত হন। বোধনের দিন থেকে দশমী পর্যন্ত এখানে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করতে পারেন সকলেই। শুধুমাত্র জেলাবাসীই নয়, ভিন রাজ্য থেকেও পুজো দেখতে বহু মানুষ ভিড় জমান কাশিপুরের এই দেবীবাড়িতে। এই পুজো আজও পুরুলিয়ার মানুষের কাছে অন্যতম দর্শনীয় মাতৃবন্দনা।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)