৭৫ লক্ষ টাকার মদ খেয়ে সর্বস্বান্ত ব্যক্তি দোষ চাপালেন নীতীশ কুমারের ঘাড়ে! ...
আজকাল | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২০১৬ সালে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের সরকার বিহারে মদ নিষিদ্ধ করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়। উদ্দেশ্য ছিল সমাজে মদের নেশা থেকে মুক্তি এনে পারিবারিক হিংসা ও সামাজিক অপরাধ কমানো। নীতীশ কুমার দাবি করেছিলেন, এই আইন বিশেষ করে মহিলাদের জন্য আশীর্বাদ হবে। কিন্তু নয় বছর কেটে যাওয়ার পরেও প্রশ্ন উঠছে—মদ নিষেধাজ্ঞা সত্যিই কতটা কার্যকর হয়েছে?
সম্প্রতি সীতামঢ়ী জেলার এক গ্রামের মটু লাল নামে এক ব্যক্তির ঘটনা রাজ্যবাসীকে নাড়িয়ে দিয়েছে। স্থানীয় চ্যানেল ITT News–এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তিনি অবৈধ মদের নেশা মেটাতে গিয়ে গত কয়েক বছরে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ লক্ষ টাকার জমি-বাড়ি বিক্রি করেছেন। আজ তাঁর পরিবার দারিদ্র্যের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত।
মটু লালের পরিবার একসময় চাষের জমি থেকে ভালো আয় করত। তাঁদের সংসারে আর্থিক অভাব ছিল না। কিন্তু মদ নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি বদলে যায়। বৈধ মদ পাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি অবৈধ ও দুষ্প্রাপ্য মদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। দাম বেড়ে যায় বহুগুণে। সেই নেশার টানেই একে একে বিক্রি করতে হয় জমি, ঘর ও অন্যান্য সম্পত্তি। এখন তিনি ভাড়া জায়গায় একটি ছোট ফাস্টফুডের দোকান চালান। মটু লাল বলেন, “গ্যাসের সংযোগও আর নেই। রান্না করতে হয় চুল্লিতে। আমাদের জীবনে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। আমার পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে বেঁচে আছে, এর জন্য দায়ী মদ নিষিদ্ধের আইন।”
মটু লালের মা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আগে তাঁদের সংসারে কোনো অভাব ছিল না। কৃষিকাজ থেকে ভালো আয় হতো, জমির দামও যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তাঁর ছেলে মদের নেশায় সব উড়িয়ে দিয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “আমাদের পরিবার একসময় সুখে-শান্তিতে ছিল। এখন আমরা ভিক্ষার মতো জীবন কাটাচ্ছি। মদ নিষেধাজ্ঞার পরে আমাদের ছেলের নেশা আরও খারাপ দিকে গিয়েছে। নীতীশ কুমারের সরকার দাবি করে, মদ নিষিদ্ধ হওয়ার পর পারিবারিক হিংসা, নারী নির্যাতন ও অপরাধের হার কমেছে। মহিলা ভোটারদের একাংশ এই সিদ্ধান্তকে সমর্থনও করেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে রাজ্যে বেড়েছে কালোবাজারি, মদ পাচার এবং অবৈধ ব্যবসা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মদ নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে যারা একেবারেই নেশা ছাড়তে পারেনি, তারা বাধ্য হয়েছে বেশি দামে গোপনে মদ কিনতে। এতে যেমন আর্থিক সর্বনাশ ঘটছে, তেমনই বেড়েছে ভেজাল মদের ঝুঁকি। প্রায় প্রতি বছরই বিহারের বিভিন্ন জেলায় বিষাক্ত মদ পান করে বহু মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মটু লালের ঘটনা সেই বিপর্যস্ত বাস্তবের আরেকটি দৃষ্টান্ত।
সীতামঢ়ীর মেহসৌল এলাকায় গত ৫ জুলাই ঘটে যায় আরেকটি ভয়ঙ্কর ঘটনা। এক মদ্যপ অটোচালক হঠাৎ তাঁর গাড়ি সরাসরি রেললাইনের ওপর চালিয়ে দেন। ঠিক সময়ে ট্রেন থামানো সম্ভব হওয়ায় প্রাণহানি এড়ানো গেছে। এই ঘটনার ভিডিও এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। অনেকেই বলছেন, মদ নিষিদ্ধ থাকলেও মাতাল চালকদের কারণে দুর্ঘটনার আশঙ্কা কমেনি। বরং অবৈধ মদের কারণে মদের মান নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, ফলে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।
মদ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিহারের রাজনীতিতে শুরু থেকেই বিতর্ক রয়েছে। বিরোধীরা অভিযোগ তুলছে, সরকার এই আইন চাপিয়ে দিয়ে রাজ্যের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মদ বিক্রির বৈধ রাজস্ব বন্ধ হয়ে গেছে, অথচ একই সঙ্গে বেড়েছে অবৈধ লেনদেন। প্রশাসনের একটি বড় অংশও এই কালোবাজারি থেকে লাভবান হচ্ছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। অন্যদিকে, শাসক শিবির বলছে—নীতীশ কুমারের সিদ্ধান্ত সামাজিক সংস্কারের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের দাবি, বহু পরিবারে স্বস্তি ফিরেছে, বিশেষত মহিলারা মদ নিষিদ্ধ হওয়ার পর গার্হস্থ্য হিংসা থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মদ নিষিদ্ধ করার আগে আসক্ত মানুষদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কাউন্সেলিং, বিকল্প নেশা নিরোধক কর্মসূচি বা সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হলে পরিস্থিতি হয়তো আলাদা হতে পারত। ফলে যাঁরা অভ্যাসগতভাবে মদ্যপ ছিলেন, তাঁরা বাধ্য হয়েছেন অবৈধ বাজারে যেতে। এর ফলে পরিবার ধ্বংস হচ্ছে, আবার রাজ্যের আইনশৃঙ্খলাও বিপর্যস্ত হচ্ছে।
মটু লালের ৭৫ লক্ষ টাকার সর্বনাশ এক ব্যক্তিগত কাহিনি হলেও তা আজ বিহারের একটি বড় সামাজিক সমস্যার প্রতিফলন। একদিকে মদ নিষিদ্ধ করার সুফল যেমন আছে, অন্যদিকে তার অপব্যবহার ও কালোবাজারির দিকও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রশ্ন উঠছে, কেবল নিষেধাজ্ঞা দিয়েই কি সমাজ থেকে মদের অভিশাপ দূর করা সম্ভব? নাকি প্রয়োজন আরও বৈজ্ঞানিক, মানবিক ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ?