ভারতের নির্বাচনে রাজনৈতিক দল নয় ‘নোটা’ই আসল সমাধান? গণতন্ত্রের শক্তি না কি দুর্বলতা?
আজকাল | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
গোপাল সাহা
বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো দ্বারা নির্মিত। তাই বলা হয় গণতন্ত্রের সর্ববৃহৎ উৎসব ভোট উৎসব। জনগণের এই ভোট দ্বারাই নির্বাচিত হয় কোন রাজনৈতিক দল রাজ্য তথা দেশে সরকার গঠন করবে। কারণ ভারতের গণতান্ত্রিক এই যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে নির্বাচন পদ্ধতি যে ভোটদান করা হয় তার প্রধান কান্ডারি হল জনগণ। কিন্তু সেই জনগণের একাংশ যদি কোন রাজনৈতিক দলকে বেছে না নিয়ে অন্য কোথাও ভোট দিতে চান তাহলে বেছে নেওয়া ‘নোটা’ বলে একটি বিশেষ অপশন। যা ইভিএম মেশিনে একদম নীচে ‘নোটা’ বলেই উল্লেখ করা থাকে। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন ‘নোটা’র কার্যকারিতা ভোটে জারি করে।
নোটা ও নির্বাচন
ভারতে NOTA (None of the Above)-এর অর্থ হল ভোটার তাঁর এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কাউকেই ভোট দিতে চান না।
আইন কী?
২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে (PUCL vs Union of India) EVM-এ NOTA বোতাম চালু হয়। যদি কোনও কেন্দ্রে নোটা সর্বাধিক ভোট পায়, তবুও নির্বাচনের ফলাফল বাতিল হয় না। সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রার্থীই বিজয়ী হন। এমনকি, নির্বাচিত প্রার্থী যদি নোটার থেকে কম ভোট পান তাহলেও।
কেন ভোট বাতিল হয় না?
ভারতীয় নির্বাচনী আইনে নোটাকে শুধুই ভোটারের অসন্তোষ প্রকাশের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যান্য দেশে (যেমন নেপাল, রাশিয়া) কিছু ক্ষেত্রে নোটা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে ভোট বাতিল হয় এবং পুনর্নির্বাচন হয়। কিন্তু ভারতে এখনও তেমন কোনও আইন নেই। বলাবাহুল্য, ভারতে নোটা ভোট যতই বেশি হোক না কেন, নির্বাচনের ফলাফল কখনও বাতিল হয় না।
ভারতের নির্বাচনে ‘নোটা’ (NOTA)-র জন্ম ও তার ব্যবহার
২০১৩ সাল থেকে ভারতীয় নির্বাচনে ব্যালট পেপারে ‘নান অফ দ্য অ্যাবাভ’ (None of the Above বা NOTA) একটি বিকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই বিকল্পটি ব্যবহার করে ভোটাররা স্পষ্টভাবে জানাতে পারেন যে তাঁরা তালিকাভুক্ত কোনও রাজনৈতিক দলের প্রার্থীকে সমর্থন করছেন না। ওই বছর একটি মামলায় রায়দানের সময় সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেয় যে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে নোটা-কে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রথমবারের মতো নোটা ব্যবহৃত হয় ২০১৩ সালের ছত্তীসগড়, মিজোরাম, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচন এবং দিল্লি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের নির্বাচনে। প্রবর্তনের পর থেকে ধীরে ধীরে NOTA ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বহু ক্ষেত্রে এটি বিধানসভা নির্বাচনে বেশ কিছু প্রার্থীর তুলনায় বেশি ভোট পেয়েছে। এমনকি কিছু পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীর চেয়েও বেশি ভোট পেয়েছে নোটা।
নোটা নিয়ে কী বলছে নির্বাচন কমিশন
কমিশন (ECI) জানিয়েছে, “যদি কোনও চরম পরিস্থিতিতেও NOTA-র (None of the Above) বিপক্ষে পড়া ভোটের সংখ্যা প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটে চেয়ে বেশি হয়, তবুও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বাধিক ভোট পেয়েছেন তাকেই জয়ী ঘোষণা করা হবে।”
২০১৩ সালে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল যে, NOTA-র জন্য প্রদত্ত ভোট নিরাপত্তা জামানত বাজেয়াপ্ত করার ক্ষেত্রে গণনায় ধরা যাবে না। ২০১৪ সালে নির্বাচন কমিশন রাজ্যসভা নির্বাচনে প্রথমবার NOTA চালু করেছিল। তবে, ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যসভা নির্বাচনে ‘None of the Above’ (NOTA) বিকল্প বাতিল করে দেয়। ২০১৫ সালে নির্বাচন কমিশন নোটা বিকল্পের প্রতীক ঘোষণা করে। যা ডিজাইন করেছিল আহমেদাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজাইন (NID)। এর আগে দাবি উঠেছিল যে, নির্বাচন কমিশন যেন নোটার প্রতীক হিসেবে গাধার প্রতীক ব্যবহার করে।
সুপ্রিম কোর্টে মামলার ভিত্তিতে নোটা নিয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল, আমরা নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিচ্ছি যে ব্যালট পেপার/ইভিএমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং ইভিএমে একটি আলাদা বোতাম ‘নান অব দ্য অ্যাবাভ’ (NOTA) যুক্ত করতে হবে, যাতে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে এসে যদি মনে করেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা কোনও প্রার্থীকে ভোট দিতে চান না, তবে তারা গোপনীয়তা বজায় রেখে তাদের ভোট না দেওয়ার অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। সুপ্রিম কোর্ট আরও বলেছিল যে, দেশের সুশাসনের জন্য উচ্চ নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করা অত্যন্ত জরুরি। নোটা বোতামের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থীর মনোনয়ন দিতে বাধ্য করা যেতে পারে।