• সেই ডানলপ নেই, সেই রোশনাই নেই! বিশ্বকর্মা পুজোয় কারখানার গেটে প্রণাম কর্মহীন শ্রমিকদের
    আনন্দবাজার | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • শিল্পাঞ্চল হিসাবে হুগলির পরিচিতি গড়ে ওঠে গঙ্গাপারে চটকল এবং অন্য কয়েক’টি কারখানা দিয়ে। হইহই করে এসেছিল ডানলপ। বিশ্বকর্মা পুজো ছিল এখানকার শ্রমিকদের কাছে দুর্গাপুজো। উৎসব, আলো, খাওয়া-দাওয়া— গোটা দিন শ্রমিক পরিবারের কাছে ছিল আনন্দের। বছরভর অপেক্ষায় থাকতেন শ্রমিক-সন্তানেরা। সেই জৌলুস অতীত। হুগলির গর্ব ডানলপ এখন অতল অন্ধকারে। কিন্তু সোনালি অতীত ভুলতে পারেন না প্রাক্তন শ্রমিকেরা। বুধবার বিশ্বকর্মা পুজোর দিন অনেকে বন্ধ কারখানার গেটের সামনে জড়ো হলেন। দূর থেকে করজোড়ে নমস্কার করলেন। কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীর পায়ে এগোলেন বাড়ির দিকে।

    বাংলা তো বটেই, দেশের প্রথম টায়ার কারখানা ছিল সাহাগঞ্জের ‘ডানলপ।’ এই কারখানার শ্রমিকেরা গর্বের সঙ্গে বলতেন, ‘আমরা ডানলপের শ্রমিক।’ সর্বদা কর্মব্যস্ত কারখানায় এখন শ্মশানের স্তব্ধতা। ছাবারিয়ার হাতবদল হয়ে রুইয়ার হাতে গেলেও ডানলপের ভবিষ্যৎ সেই তিমিরেই। ২০১১ সালে সাসপেনশনের নোটিস ঝোলে ডানলপে। তার পর কারখানার তিন শিফ্টের কাজ, হাজারো ব্যস্ততা, সব নিমেষে উধাও হয়। শ্রমিকেরা পিএফ গ্র্যাচুইটি বকেয়ার দাবি জানাতে থাকেন। আর কাঁচামাল সরবরাহকারী অন্য পাওনাদারেরা মামলা করেন হাই কোর্টে।

    ২০১৭ সালে কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে লিকুইডেশনে চলে যায় দেশের প্রথম অ্যারো টায়ার প্রস্তুতকারী কারখানা। এ রাজ্যের সাহাগঞ্জ এবং তামিলনাড়ুর আম্বাতুরে ডানলপের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিলাম করে বকেয়া মেটাতে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। তার পরেও আশায় ছিলেন বহু শ্রমিক। বিশেষ করে যাঁরা কোম্পানির কোয়ার্টারে ছিলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু চোখের সামনে সমস্ত কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে দেখে সেই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। মঞ্চ বেঁধে ধর্না দিয়েছেন অনেকে। কিন্তু ডানলপের পরিস্থতির বদল হয়নি। বিশ্বকর্মা পুজো হলেই বুকের কাছটা হু-হু করে ওঠে তাঁদের।

    বিশ্বকর্মা পুজো উপলক্ষে সপ্তাহভর আয়োজন চলত ডানলপে। শুধু কারখানার কর্মীরাই নন, আশপাশের বাসিন্দাদের কাছেও এখানকার পুজো ঘিরে আবেগ-উন্মাদনা ছিল অন্য রকম। এই একটা দিন সাধারণ মানুষও কারখানার ভিতরে ঢুকতে পারতেন। নিজেদের চোখে দেখতে পারতেন কী ভাবে টায়ার তৈরি হয়। এখন কেবল অতীতের স্মৃতিচারণ। স্থানীয় এক প্রৌঢ়ের কথায়, ‘‘পুজোর দিন মেলা বসত। খাওয়া-দাওয়া হত। নাটক-থিয়েটার হত। কত রমরমা ছিল। আজ সেখানকার শ্রমিকেরা দিন আনে দিন খায়।’’ কারখানার অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক নির্মল সিংহ, অসীম বোসেরা বলেন, ‘‘বিশ্বকর্মা পুজো এলেই মনখারাপ হয়। আগে খুব আনন্দ করতাম তো। পুজোর সময় কারখানায় অবাধে যাতায়াত ছিল মানুষের। এখন দেখুন, শ্মশানের নিস্তব্ধতা!’’ আবেগে চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে তাঁদের।

    সম্প্রতি রাজ্য সরকার বিধানসভায় বিল এনে ডানলপ অধিগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। যে ক’জন শ্রমিক ‘পে রোলে’ রয়েছেন, তাঁদের ভাতা দেয় রাজ্য। কিন্তু তাতে পরিবারের সকলের পেট ভরে কই!

    ডানলপ কারখানার পশ্চিম দিকের গেটের পাশে রয়েছে লোহার পাতে লেখা ‘ডানলপ’। মরচে পড়েছে তাতে। আশপাশে ঘন বন-জঙ্গল। তবুও বিশ্বকর্মা পুজো এলেই কারখানার গেটের সামনে দাঁড়ান প্রাক্তন শ্রমিকেরা। প্রণাম করে যান। এই কারখানাই যে ভাত জুগিয়েছে এক সময়! সকলে চান আবার খুলে যাক ডানলপের গেট, আবার ডানলপ মাতুক বিশ্বকর্মা পুজোয়।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)