• চিকিৎসায় ‘মারাত্মক অবহেলা’ প্রমাণ না-হলে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ টিকবে না! পর্যবেক্ষণ কলকাতা হাই কোর্টের
    আনন্দবাজার | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • চিকিৎসায় ‘মারাত্মক অবহেলা’ প্রমাণ করতে না পারলে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা টিকবে না। সন্তানহারা এক পিতার মামলায় বুধবার এমনটাই জানিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। আদালতের বিচারপতি অজয়কুমার মুখোপাধ্যায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ফৌজদারি মামলায় প্রমাণ করতে হবে যে, একজন চিকিৎসক তাঁর কাজে এমন অবহেলা করেছেন, যা অন্য কোনও সাধারণ, সৎ এবং বিচক্ষণ চিকিৎসক করতেন না। অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সমন খারিজ করে দিয়ে হাই কোর্টের রায়, অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য একটি স্বাধীন মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করবে নিম্ন আদালত। ওই মেডিক্যাল বোর্ডের মতামতের ভিত্তিতে নতুন করে বিচার করতে হবে।

    ঘটনার সূত্রপাত ২০১৪ সালে। ওই বছরের ১০ জুলাই বিকেল ৪টে নাগাদ সিঁড়ি থেকে পড়ে যান অভিযোগকারী রঞ্জিত সরকারের সন্তান। তাঁর পেটে এবং কোমরে চোট লাগে। ওই দিনই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাকে। পরিবারের দাবি, ভর্তির সময় রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু ওই রাতে চিকিৎসক শুধুমাত্রের মেরুদণ্ডের আঘাত পরীক্ষা করেন। পেটে ব্যাথার বিষয়টি পরীক্ষা করা হয়নি বলে অভিযোগ। এমনকি রোগীর রক্তচাপ, নাড়ির স্পন্দন (পাল্‌স রেট), শ্বাসপ্রশ্বাসও রেকর্ড করা হয়নি বলে দাবি পরিবারের।

    হাসপাতালে ভর্তির পরে প্রথম রাতে তীব্র পেট ব্যথায় ভোগে রোগী। অভিযোগ, সেই সময় সারা রাতে নার্স তার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করেননি। পরের দিন (১১ জুলাই) সকাল ১০টা নাগাদ রোগীর রক্ত পাতলা করার একটি ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। পরিবারের দাবি, ওই ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরেই রোগীর রক্তচাপ হঠাৎ কমে যায়। পেটও ফুলে ওঠে। এর পরে প্রচণ্ড ঘাম হয় এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। তখন তাকে হাসপাতালের সাধারণ বেড থেকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু সে দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার আগে রোগীকে পরীক্ষা করা হয়নি বলে অভিযোগ পরিবারের। তার পরের দিন (১২ জুলাই) সন্ধ্যায় রোগীর মৃত্যু হয়।

    অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং শারীরিক জটিলতায় মৃত্যু হয় রোগীর। হাসপাতালের তরফে মৃত্যুর শংসাপত্রে জানানো হয়, স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে রোগীর। কিন্তু রোগীর বাবার দাবি, সেটি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। সঠিক চিকিৎসা না করা এবং ভুল ইঞ্জেকশন দেওয়ার কারণেই তাঁর ছেলের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন রঞ্জিত। এ নিয়ে ২০১৭ সালে ব্যারাকপুর আদালতে মামলা করেন তিনি। চিকিৎসায় অবহেলার কারণে মৃত্যুর অভিযোগের প্রেক্ষিতে নিম্ন আদালত অভিযুক্ত চিকিৎসক রবি গণেশ ভরদ্বাজের বিরুদ্ধে সমন জারি করে।

    ওই সমনকে চ্যালেঞ্জ করে ২০১৮ সালে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন অভিযুক্ত চিকিৎসক। অভিযুক্তের হয়ে আদালতে মামলা লড়েন আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায়। তাঁর সওয়াল, চিকিৎসায় সামান্য ভুল বা বিবেচনায় ত্রুটি সবসময় অপরাধ হিসাবে গণ্য করা যায় না। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ আনার আগে কোনও মেডিক্যাল বোর্ডের মতামত নেওয়া উচিত ছিল বলে আদালতে জানান আইনজীবী। তিনি আরও জানান, অভিযুক্ত চিকিৎসক ব্যারাকপুর আদালতে বিচারাধীন এলাকার বাইরের বাসিন্দা। এ ক্ষেত্রে সাবেক ফৌজদারি দণ্ডবিধি (সিআরপিসি) অনুসারে, অভিযুক্ত বিচারাধীন এলাকার বাইরের বাসিন্দা হলে, তাঁর বিষয়ে তথ্য যাচাই বাধ্যতামূলক। এ ক্ষেত্রে তা হয়নি বলেই হাই কোর্টে জানান তিনি।

    অন্য দিকে মৃতের বাবা কোনও আইনজীবী নিয়োগ করেননি। তিনি নিজেই আদালতে সওয়াল করেন। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ অজয় গুপ্তের একটি রিপোর্টও তুলে ধরেন তিনি। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, রোগীকে অযথা তিনটি রক্ত পাতলা করার ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে রোগীর শরীরে তিন লিটার রক্তক্ষরণ হয় এবং ‘হেমোরেজিক শক’ হয়ে রোগীর মৃত্যু হয়। এটি ‘ক্রিমিনাল মেডিক্যাল নেগলিজেন্স’ বলেও রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে। অভিযোগকারী জানান, রিপোর্ট অনুযায়ী স্পষ্ট, অবহেলা প্রমাণিত। তাই অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা খারিজ না করার জন্য আদালতে আবেদন জানান তিনি।

    তবে হাই কোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছে, নিম্ন আদালত এ ভাবে সমন জারি করতে পারে না। বিচারপতি মুখোপাধ্যায় বক্তব্য, নিম্ন আদালতের বিচারক কোনও চিকিৎসাবিদ নন। ওই ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরেই মৃত্যু হয়েছে, তা তিনি কী ভাবে ধরে নিলেন? কোনও স্বাধীন মেডিক্যাল বোর্ডের মতামত কেন নেওয়া হয়নি, তা নিয়েও প্রশ্ন হাই কোর্টের। এ অবস্থায় অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সমন বাতিল করে দিয়েছে হাই কোর্ট। বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের রায়, কমপক্ষে তিন জন সরকারি চিকিৎসককে নিয়ে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করতে হবে। অভিযোগকারীকে মেডিকেল বোর্ডের কাছে সব নথি জমা দিতে হবে। সব কিছু যাচাই করে মেডিকেল বোর্ড কী মতামত দেয়, তার উপর ভিত্তি করে আবার নতুন ভাবে বিচার করবে ব্যারাকপুর আদালত।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)