আইনি ‘রক্ষাকবচ’ নিয়েই কি এ বার দেদার জলাশয় ভরাট শুরু হবে? আপাতত এই শঙ্কাই দৃঢ় হচ্ছে কলকাতা-সহ রাজ্যের পরিবেশবিদদের একাংশের মধ্যে। কারণ, গত শুক্রবার রাজ্যের ভূমি ও ভূমি সংস্কার এবং শরণার্থী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতরের তরফে প্রকাশ করা সরকারি মেমোয় বলা হয়েছে— এ বার থেকে জলাশয় ভরাট করতে চাইলে আবেদনকারীকে বাধ্যতামূলক ভাবে তৈরি করতে হবে ক্ষতিপূরক জলাশয়। আবেদনের নিষ্পত্তি সর্বাধিক ১২০ দিনের মধ্যে করতে হবে এবং প্রতিটি ধাপের জন্য ১৫ দিনের সময়সীমা ধার্য হয়েছে। আর এই নীতি ঘিরেই তৈরি হয়েছে আশঙ্কা।
পরিবেশবিদদের একাংশের মতে, এই ক্ষতিপূরক জলাশয় তাত্ত্বিক ভাবে সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে এই নিয়ম জলাশয় ভরাটের অবাধ বিধির মতো কাজ করতে পারে। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত জানাচ্ছেন, জলাশয়ের পরিবর্তে আর একটি জলাশয় করে দিলেই দায় সারা হয়ে যায় না। বরং, যে জলাশয়টি তৈরি করা হল, সেটি আদৌ কতটা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে, তা-ও দেখা প্রয়োজন। তাঁর কথায়, “জলাশয় মানে শুধুই মাছ নয়। তাই একটি জলাশয় বুজিয়ে আর একটি জলাশয় তৈরি করে কয়েকটি মাছ ছেড়ে দিলেই কাজ হবে না! জলাশয় মানে মাছ ছাড়া যে সব জলজ উদ্ভিদ, শামুক, গুঁড়ি-গেগলি আছে, অর্থাৎ, সার্বিক ভাবে জলজ প্রাণ, তারা বাঁচবে কী ভাবে?”
রাজ্যের এই নীতিতে এক শ্রেণির প্রোমোটার সুযোগ পাবেন কিনা, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। কারণ, অনেকে বলছেন, এক শ্রেণির প্রোমোটার এমনিতেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জলাশয় বুজিয়ে বহুতল তোলেন। পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতেই এমন অজস্র উদাহরণ আছে, যার বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। তাঁরাই এ বার এক জায়গার জলাশয় বুজিয়ে অন্য জায়গায় আর একটি জলাশয় করে পার পেয়ে যাবেন না তো? এক পরিবেশবিজ্ঞানীর কথায়, “জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্র এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে যে জলাশয়গুলি রয়েছে, সেগুলিরই ঠিক মতো দেখাশোনা হয় না অনেক ক্ষেত্রে। সেখানে একটি নতুন জলাশয় খুঁড়ে সেটির দেখাশোনা করা হবে, এটা একটু বেশিই আশা ছাড়া কিছু নয়।”
প্রসঙ্গত, মধ্যমগ্রামের একটি আবাসন সংক্রান্ত মামলায় কলকাতা হাই কোর্ট প্রশ্ন তুলেছিল, ক্ষতিপূরক জলাশয়ের ধারণা কতটা যুক্তিসঙ্গত? সেই মামলার আইনজীবী অঙ্কুর শর্মা জানাচ্ছেন, এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ১০০ বছরের কোনও জলাশয় বুজিয়ে অন্যত্র একটি জলাশয় করলে কি আদৌ তা ক্ষতিপূরক হল? তার চেয়েও বড় কথা, এই নিয়ম শুধু জরুরি ক্ষেত্রের জন্য প্রযোজ্য ছিল। কারণ, বাড়িতে ঢোকার মুখে হয়তো একটি জলাশয় আছে, যেটি ভরানো ছাড়া বিকল্প নেই। তখন জরুরি ভিত্তিতে ওই জলাশয় বুজিয়ে আর একটি জলাশয় তৈরি করার বিধান ছিল। কিন্তু, এ বার তো সব ক্ষেত্রেই তা করা যাবে। অঙ্কুরের কথায়, “তা ছাড়া, কোনও পুরনো জলাশয় বুজিয়ে অন্যত্র একটি নতুন জলাশয় খুঁড়ে কোনও ভাবেই পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ হওয়া সম্ভব নয়।”
যদিও রাজ্য প্রশাসনের একাংশের মতে, সব দিক বিবেচনা করেই এই নতুন নীতি নেওয়া হয়েছে। জলাশয় বুজিয়ে যাতে কেউ দায় ঝেড়ে ফেলতে না পারে, তার জন্য প্রতিটি ধাপে নজরদারির কথাও বলা হয়েছে। প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, “এই নির্দেশিকা জারি করার আগে সংশ্লিষ্ট সব দফতরের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তাদের মতামত জেনেই নতুন ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর’ জারি হয়েছে।’’