স্বামীজির আদর্শ, বৈদিক আচার, মুসলিম কুমারী কন্যার পুজো বহরমপুরে
বর্তমান | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
অভিষেক পাল বহরমপুর
আচারে বৈদিক। আদর্শে স্বামীজি।—এই দুইয়ের সমন্বয়ে উমা আরাধনা বহরমপুরের মণ্ডল পরিবারে। আর সেই আরাধনার অন্যতম অঙ্গ কুমারী পুজো। মোট ১০ জন কুমারীকে দুর্গা রূপে পুজোর আয়োজন চলছে। তাদের মধ্যে একজন মুসলিম কন্যাও রয়েছে। তার বাড়ি লালবাগে। বাকি ন’জনের মধ্যে একজন আদিবাসী ও দু’জন ব্রাহ্মণ কন্যা রয়েছে। বাকিরা অন্যান্য সম্প্রদায়ের। স্বাভাবিকভাবেই মণ্ডল পরিবারের এই কুমারী পুজো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির বলে মনে করছে জেলাবাসী। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
সালটা ১৮৯৮। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীরে গিয়ে অবস্থান করছেন স্বামী বিবেকানন্দ। সেখানকার ক্ষীরভবানীর মন্দিরে থাকাকালীন এক মুসলিম মাঝির কন্যার মধ্যে দুর্গার রূপ লক্ষ্য করেন। তখনই সিদ্ধান্ত নেন ওই কন্যাকে তিনি দুর্গা সাজিয়ে পুজো করবেন। মহাষ্টমীর দিন সেটাই করলেন। স্বামীজির এমন উদ্যোগ দেখে সে সময় রে রে করে উঠেছিল দুই সম্প্রদায়েরই মৌলবাদী শক্তি। কিন্তু, নিজের মানবতার দর্শনে অনড় থেকে সমাজকে বার্তা দিয়েছিলেন—মা কারও একার নয়। স্বামীজির সেই আদর্শকে সামনে মণ্ডল পরিবারও ব্রাহ্মণ, অব্রাহ্মণ কন্যার পাশাপাশি মুসলিম কন্যাকেও দুর্গা রূপে পজো করবে এবার। এর আগে হুগলির চুঁচুড়ার ঝিঙেপাড়ার সারদা রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমেও মুসলিম কুমারী কন্যার পুজো হয়েছে।
বহরমপুর শহরের মধুপুরে অবস্থিত মণ্ডলবাড়ি। সেই বাড়ির বধূ সঞ্চালী মণ্ডল। আদ্যপ্রান্ত স্বামী বিবেকনন্দের ভক্ত। পরিবারের সকলেও স্বামীজির আদর্শে বিশ্বাসী। সেই আদর্শে ভরসা রেখেই মুসলিম কন্যাকে কুমারী পুজোর জন্য বেছে নিয়েছে মণ্ডল পরিবার। পুজো হবে পুরোপুরি বৈদিক মতে। মণ্ডল বাড়ির কর্তা স্বর্গীয় হরিহর মণ্ডল এবং গিন্নি ললিতা মণ্ডলের কনিষ্ঠ পুত্র ও পুত্রবধূর হাত ধরে চতুর্থ বর্ষে পদার্পণ করল এই পুজো। এখানে মা দুর্গা বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবে পুজিত হন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ১০ জন কুমারী কন্যার মধ্যেই মায়ের দর্শন পান পরিবারের সদস্যরা। ষষ্ঠীর দিন দেবীর বোধনে পাড়ার সকল প্রবীণ ব্যক্তিরা অংশ নেন। তিন শক্তিকে নিয়েই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়। আদতে তিন শক্তির আধার প্রকৃতি। আর প্রকৃতির গূঢ় অর্থ লুকিয়ে রয়েছে একজন কুমারীর মধ্যে। তাই, বেদজ্ঞরা কুমারীকে দেবীভাব কল্পনা করে তার পুজোর বিধান দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, কুমারী তিনিই হন, যাকে দেবী দুর্গার প্রতিভূ বলা হয়।
মণ্ডল পরিবার সেই আচার মেনেই অষ্টমীতে ১০ কুমারীর পুজো করবে। সাজিয়ে গুছিয়ে মূল প্রতিমার পাশে বসানো হবে তাদের। সবার পরণে থাকবে সালংকারা বেনারসি। পুজো দেখতে দূর দুরান্ত থেকে বহু মানুষ আসেন। সঞ্চালীদেবী বলছিলেন, ‘আমি পেশায় শিক্ষিকা। স্বামীজির আদর্শ আমার পাথেয়। শিশুদের ক্লাসে ওদেরকে শেখাই, ভেদাভেদহীন সমাজ গড়ার। বাড়ির পুজোয় তা হলে বিভেদ থাকবে কেন। তাই প্রতি বছর বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে দশ কুমারীকে দুর্গারূপে পুজোর জন্য বেছে নিই। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।’