ঘোর অনিশ্চয়তায় জীবন, পুজোর সব জৌলুস ম্লান চাকরিহারাদের কাছে
আনন্দবাজার | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
পুজো ঘিরে এ বছর তাঁদের না আছে উচ্ছ্বাস, না আছে আলাদা কোনও আবেগ। পুজো আসছে, তাঁরা জানেন। কিন্তু তাঁদের প্রশ্ন, এইপুজো তাঁরা উপভোগ করবেন কী ভাবে? গত এপ্রিল মাস থেকে তাঁদের বেতন বন্ধ। জীবনধারণ করাই যেখানে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে, সেখানে পুজো নিয়ে ভাবনাচিন্তা তাঁদের কাছে বিলাসিতা। প্রিয়জনেদের জন্য কিছু কেনার কথাও এবার ভাবতে পারছেন না তাঁরা। তাই চাকরিহারা শিক্ষাকর্মীরা (গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি) জানালেন, এ বারেরপুজোয় আলোর রোশনাই থেকে তাঁরা অনেক দূরে। জীবন ডুবে আছে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে।
সল্টলেকের বাসিন্দা, চাকরিহারা গ্রুপ সি কর্মী অমিত মণ্ডল বললেন, “পুজোর সময়ে নিজের সামর্থ্য মতো প্রিয়জনদেরজামাকাপড় দিই। মা-বাবার জামাকাপড় কিনতে ওঁদের শপিং মলে নিয়ে যেতাম। এ বছর পুজোর আগে ভিড়ে ঠাসা শপিং মলগুলি দেখলেই পালাতে ইচ্ছে করছে। আমাদের হাতে একটা পয়সাও নেই।এপ্রিল মাস থেকে বেতন বন্ধ।’’ অমিতের মতে, স্কুল সার্ভিস কমিশন যদি চাকরিহারা শিক্ষকদের মতো শিক্ষাকর্মীদের ক্ষেত্রেও (অর্থাৎ, গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি) যোগ্য এবং অযোগ্য ভাগ করে দিত, তা হলেসেটাই হত তাঁদের কাছে পুজোর শ্রেষ্ঠ উপহার। অমিত বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী আমাদের জন্য ভাতা চালুকরেছিলেন। কিন্তু সেই ভাতা যোগ্য, অযোগ্য সকলের জন্য ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই তা আদালতে আটকে গিয়েছে। আমাদের হাতে কোনওটাকা নেই। এমন পুজো কোনও বারও কাটাইনি। মাকে নিয়ে এ বার বাড়ির কাছের দুর্গা প্রতিমাও বোধহয় দেখতে যাব না।’’
চাকরিহারা আর এক গ্রুপ ডি কর্মী পূরবী মণ্ডল বললেন, ‘‘এপ্রিল থেকে আমাদের বেতন নেই। বেঁচেথাকাটাই এখন চ্যালেঞ্জ। পুজো উপভোগ করব কী ভাবে? আমরা প্রতি বছর পুজোর বোনাস পেতাম। এ বার তা-ও পেলাম না। নিজে না-হয় পুরনো শাড়ি পরে পুজো কাটিয়েদিলাম, কিন্তু প্রিয়জনেদেরও যে কিছু দিতে পারলাম না, এটাইআমাকে বার বার অবসাদে ডুবিয়ে দিচ্ছে।’’ পূরবীর মতে, ‘‘পুজোর মধ্যে একটা দিন যদি রাস্তায় নেমে আন্দোলন করা যায়, তা হলে হয়তো সাধারণ মানুষও মণ্ডপে ঘোরার পাশাপাশি আমাদের দেখেবুঝতে পারবেন, আমরা কত কষ্টে আছি।’’
চাকরিহারা গ্রুপ ডি কর্মী ইন্দ্রজিৎ সরেন এখন দিনমজুরেরকাজ করেন। যে দিন কাজ পান, সে দিন ১৮০ টাকা করে হাতে আসে। ইন্দ্রজিৎ বলেন, ‘‘বাড়িতে মা আছেন, স্ত্রী আছেন, ছোট বাচ্চা আছে।পুজোয় জামাকাপড় কেনা তো দূর, বরং বলা যায়, এক বেলা না খেয়ে দিন চলছে। বাড়ির কাছে একটি শিউলিগাছ আছে। তাতে ফুল ফুটলে বুঝতে পারি, পুজো আসছে। এ বারও ফুল ফুটেছে। কিন্তু আমার কাছে পুজোর কোনও গন্ধ নেই।’’
এসএসসি-র তালিকায় থাকা চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকারাও জানাচ্ছেন, পুজো ঘিরেএ বার তাঁদেরও উচ্ছ্বাস নেই। পুজো নিয়ে কিছুই ভাবছেন না তাঁরা। ‘চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চ’-এর সদস্যেরা কয়েক জন জানালেন, লিখিত পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। পুজোর পরে ফলবেরোবে। এ বার দুরু দুরু বুকে ফলের জন্য অপেক্ষা করা। পাশ করতে না পারলে ডিসেম্বর থেকেই তাঁরা চাকরিহারা হয়ে যাবেন। তাঁরা বার বার সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন যে, এসএসসি-রতালিকায় থাকা যোগ্য চাকরিহারাদের যেন আর পরীক্ষা দিতে না হয়। কিন্তু সরকার, আদালত কোনও কথা শোনেনি। তাই তাঁদের ফের পরীক্ষায় বসতেই হয়েছে। ফলে, এখন পুরো অনিশ্চিত তাঁদের জীবন।এই অবস্থায় কি পুজো উপভোগ করা যায়? পাল্টা প্রশ্ন ওই সব চাকরিহারা শিক্ষকের।
চাকরিহারা শিক্ষিকা সঙ্গীতা সাহা বললেন, “৩১ ডিসেম্বরেরপরে যদি চাকরি না থাকে, এই আতঙ্কে পুজোয় কোনও আনন্দই করতে পারছি না। গত কয়েক মাসে আমাদের দু’জন সহকর্মী মারা গিয়েছেন। চাকরি হারানোর উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা থেকেই ওঁদের এমন পরিণতিহয়েছে বলে জানতে পেরেছি। চাকরিহারারা অনেকেই অবসাদে ভুগছেন। এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে পুজো উপভোগ করব? এ বারের পুজো যেন তাড়াতাড়িকেটে যায়, এটাই চাইছি। তবু যদি মণ্ডপে যাই, মা দুর্গার কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা করব, ২০১৬ সালের প্যানেলের সমস্ত যোগ্যচাকরিহারারা যেন তাঁদের চাকরি ফিরে পান। তাঁরা যেন ফের সসম্মানে স্কুলে ফিরতে পারেন।’’