তালপাতার সেপাই থেকে পোড়ামাটির পুতুলের বাঁশি, পুতুলনাচের এই ইতিকথাই তুলে ধরেছিল ‘খামখেয়াল’...
আজকাল | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: দক্ষিণ কলকাতায় খামখেয়াল নামক একটি সংগঠন আয়োজন করেছিল "আর্ট অ্যান্ড অটাম'' নামে এক প্রদর্শনীর। চলতি মাসেই যা হয়ে গেল। এই শিল্প ও শরতের হাজার ভাবনায় আলাদা কী দেখা গেল?
দেখা গেল শুধু শিল্প নয়, সেই শিল্পের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ঋতুর ছোঁয়া, ঐতিহ্যের গন্ধ, আর সমাজ জীবনের আখ্যান। আরও দেখা গেল শাড়ি জামা কাপড় এসবের বাইরেও, ছুটে আসা একদল সৈনিক। তালপাতার সৈনিক! তবে এ সৈনিক বন্দুক হাতে যুদ্ধ করতে আসেনি ,এরা শৈশবের সঙ্গী, লোককথার চরিত্র।
'তালপাতার সেপাই' গান অনেকেই শুনেছেন। কিন্তু এই পুতুল বানান কে? তিনি সুনীল দাস। নন্দন প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে বইমেলা - সব জায়গায় নিজের হাতে বানানো তালপাতার সেপাই নিয়ে হাজির হন। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে হাতেগোনা যে ক'জন মানুষ এই লোক ঐতিহ্যকে নিজের কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন সুনীলবাবু তাঁদের মধ্যে একজন। শোনা যায় এই শিল্পের উৎস ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময়। বর্ধমান জেলায় এই শিল্পের সৃষ্টি হলেও পরবর্তী সময়ে তা পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। পরাধীন ভারতে কলকাতার বারোয়ারি ক্লাবগুলিতে যখন বীরাষ্টমী পুজো হত সেখানেও এই তালপাতার সেপাইদের সন্ধান মিলত। আজকের দিনে যেখানে প্লাস্টিক আর মেশিনের খেলনাই চারপাশ দখল করেছে, সেখানে তালপাতার এই সৈনিক যেন এক প্রতিরোধের প্রতীক।
চোখে পড়েছিল জয়নগরের পুতুল। হ্যাঁ মোয়া নয়, পুতুল! প্রায় আট পুরুষ ধরে দাস পরিবার গড়ে চলেছেন এই অনন্য শিল্প। যার বর্তমান কান্ডারী শম্ভুনাথ দাস। মূলত স্থানীয় জমিদার পরিবারের জন্য মাটির পুতুল বানাতেন এই দাস পরিবার। তাঁর শিল্পের গঠন কাঠামো ও প্রকোষ্ঠে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর ছাপ রয়েছে। তিনি তাঁর পুতুলে তুলে ধরেছেন সমাজ জীবনের নানান চরিত্র - সিপাহী, পুলিশ, বাবু, পিয়ন, গোয়ালিনী.. আজও তাঁর সৃষ্টিতে লুকিয়ে থাকে ইতিহাসের গন্ধ। শিল্পী রাজকুমার দেবনাথ ৪০ বছর ধরে বাঁশি পুতুল শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁর কাজের মাধ্যমে। ছোটবেলায় তাঁর বাবার কাছে শেখা এই শিল্পকলা। এই পোড়ামাটির পুতুলে ফুঁ দিলেই শোনা যায় বাঁশির শব্দ। পশ্চিমবঙ্গের কিছু বিক্ষিপ্ত জায়গায় এই বাঁশি পুতুল দেখা গেলেও, শহরে তা বিরল। আর এই ক্রমবর্ধমান 'প্রগতির' যুগে, গ্রাম বাংলাতে ওই শিল্প যে বিরলতর হয়ে যাচ্ছে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
এর সঙ্গেই এই প্রদর্শনীতে ছিল বহু স্বতন্ত্র ব্যবসায়ী ও স্বাধীন সঙ্গীত ও নৃত্যশিল্পীরা। গান থেকে শুরু করে 'রেস্টোরেশন আর্ট', আর কুরুশশিল্প থেকে সূচিশিল্প সবকিছুই এসে ধরা দিয়েছিল এই প্রদর্শনীতে। সংগঠকদের মতে তাঁরা প্রতিবারই এমন কিছু শিল্পী আর শিল্পসত্তাকে তুলে ধরতে চান যেগুলো একটু আলাদা। তাঁরা মনে করেন সময়ের প্রবাহ শিল্পসত্তার প্রতিকূল হলেও, দেশের শিল্প বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সকলেরই। বড় নামের দরকার নেই… ছোট ছোট বিন্দুতেই যে গড়ে উঠবে সিন্ধু, সেই বিশ্বাসেই তাঁদের খামখেয়াল!