রমেন দাস: মেট্রোয় বিপর্যয়! অথবা মেট্রোয় দুর্ভোগ! নিত্যযাত্রীদের হরেকরকম খবর ছাড়িয়ে বউবাজারের গোয়েঙ্কা কলেজের বিপরীতের রাস্তায় ঢুঁ মারলেই আচমকা বাজতে থাকে বেদনার বাঁশি! কেমন যেন সব পেয়েছির দেশেও চওড়া হয় হাহাকার! তিলোত্তমার আলো ঝলমলে দুর্গোৎসবের মঞ্চেই বাঁচার আশা খোঁজেন ওঁরা!
কথায় বলে কারও পৌষমাস, কারও সর্বনাশ! শিয়ালদহ থেকে বউবাজার মেট্রো সংযোগে সুবিধা হয়ে বহু মানুষের! কিন্তু বহু বহু ঢক্কানিনাদের ঝংকারে ঢেউ তুলেছে অনেকের দুঃখ! নিজের বাড়িতেই আতঙ্কে ভরেছে ওঁদের মন! নিরন্তর মৃত্যুভয়ে আজও ওঁরা বলছেন, বাঁচব তো মা!
বউবাজার এলাকার দুর্গাপিতুরি লেন। কলকাতা মেট্রোর সুবাদে এই এলাকার। নাম বারবার এসেছে খবরের শিরোনামে। কখনও মেট্রোর টানেলে জল, কখনও বাড়িতে ফাটল। আবার কখনও একাধিক সমস্যা। এক রাতেই ঘরছাড়া করেছে উত্তর কলকাতার একাধিক বাসিন্দাকে। এই রাস্তার আশপাশের রাস্তার বাসিন্দাদের অনেকেই বিপদে পড়েছেন আচমকা! মুহূর্তেই নিজের বাড়ি ছেড়েই যেন দেশছাড়া হয়েছেন ওঁরা! ২০১৯ এর আগে যে পুজোয় সেজে থাকত পুরো পাড়া! যে রাস্তার ধারে বসত আড্ডার আসর। সেই পাড়ার বাসিন্দাদের বদলেছে পুজো! প্রত্যেক দিন, প্রত্যেক মুহূর্তে সংসার যাপনের ইচ্ছায় নেমে এসেছে আতঙ্ক! আনন্দ পর্যবসিত হয়েছে ভয়ে! তাই পুজো এখানে ম্লান! দেবী দুর্গার কাছে রোজ প্রার্থনা করেন ওঁরাও। প্রশ্ন তোলেন মেট্রোর ভূমিকায়। অভিযোগ ওঠে কেএমসিআরএলের বিরুদ্ধেও।
২০১৯ এর আগস্ট মাসের শেষদিন। ৯ নম্বর দুর্গাপিতুরি লেনের বাসিন্দা অমিত সেন ‘ঘরছাড়া’ হয়েছিলেন। কলকাতার সুখ-পথের তোড়ে অন্য অনেকের মতো তাঁকেও উঠতে হয়েছিল কোনও হোটেলে। মেট্রো দুর্ভোগে মুহূর্তেই বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন নিজের ঘর থেকে। তারপর?
প্রায় এক বছর হোটেল, ফ্ল্যাট মিলিয়ে নিজের বাড়ির বাইরে কেটেছে ওঁদের। মেট্রোর কাজ হয়েছে। সম্প্রতি সম্পন্ন হয়েছে সব। কিন্তু ২০১৯ থেকে সেই আতঙ্ক নিয়েই ঘরে ফিরেছেন ওঁরা। কয়েকবছর আগে থেকেই প্রত্যেক মুহূর্তে আঁচ করেছেন জীবনের ভয় কাকে বলে! কিন্তু এসবের মধ্যেও কেমন কাটে পুজো? ওই এলাকার বাসিন্দা অমিত সেন বলছেন, ‘আগে পুজোয় একটা আনন্দ ছিলেন। বিশ্বাস করুন এখন আর সেটা নেই। আতঙ্ক একটা আলাদা জিনিস, কিন্তু রোজ আমাদের মৃত্যুভয়ে দিন কাটে। মনে হয় ঘুমিয়ে আছি রাতে, সকালে আর বাঁচব তো?’ কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে দুর্গাপিতুরি লেনের বাসিন্দার। তাঁর কথায়, ‘২০১৯ সালের আগস্ট মাসে বাড়ি ছাড়তে হয়। প্রথমে হোটেল তারপর ফ্ল্যাটে রাখা হয়। ২০২১ সালে বাড়িতে ফিরে আসি আমরা। লোহার রড দিয়ে বাড়িতে ঠেকনা দেওয়া হয়েছে। আমার অসুস্থ বাবা থাকেন বাড়ির নিচের তলার ঘরে, সেই বড় বড় লোহার বিম নিয়ে তাঁকে থাকতে হচ্ছে।’
পুজোর কথা বলতে বলতেই আরও ভয়ঙ্কর অভিযোগ করছেন অমিত সেন। তিনি বলছেন, ‘রোজ যখন বাড়ির নিচ থেকে মেট্রো কাছে, কম্পন অনুভব করি। সব কাঁপে। এমনকি রাতের শেষ মেট্রো যখন যাচ্ছে ভয়ংকর আওয়াজ পাচ্ছি। সকালে ট্রায়াল চলার সময়ও আওয়াজ পাওয়া যায়। ভয় লাগে!’ পুজোয় এই ভয় নিয়েই বাঁচেন ওঁরা। একাধিক পরিবারের প্রায় একই অবস্থা! অমিতের কথায়, ‘আগে পুজোয় আত্মীয়রা আসতেন, এখন তাঁরা কেউ আসেন না! সকলেই ভয় পান। নিজেদেরও ভালো লাগে না কিছুই।’
ক্ষতিগ্রস্ত ওই বাসিন্দার অভিযোগ, ‘বারবার কাজের কথা অর্থাৎ বাড়ি সারিয়ে দেওয়ার কথা বললেও কাজ হচ্ছে না। কলকাতা পুরসভা, স্থানীয় কাউন্সিলর থেকে শুরু করে মেট্রো, বারবার আবেদন করেছি আমরা। নির্দিষ্ট কিছু অংশে কাজ শুরু হলেও আমাদের জন্য এখনও কিছু করা হয়নি। কেএমসিআরএল আধিকারিকদের বললেও কোনও কাজ হয় না। এই রাস্তাতেই কাউন্সিলরের অফিস রয়েছে, তিনি নিজেও এই কম্পন অনুভব করেন!’ এখনও বিচার চাইছে বউবাজারের এই এলাকা। ভেঙে যাওয়া অথবা ফেটে যাওয়া বাড়ির মতোই ওঁরাও চান ফের পুজোয় আতঙ্কহীন জীবন বাঁচাতে! কিন্তু উপায়?