রায়বাড়ির পুজোয় থাকে না লক্ষ্মী ও সরস্বতী, গ্রাম্য নারীর বেশে পুজো চেয়েছিলেন দেবী মহামায়া
বর্তমান | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
দীপন ঘোষাল, রানাঘাট: সময়টা ভাদ্রের শেষ কিংবা আশ্বিনের শুরু। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাব্দী আগের কথা। ভাদ্রের ভয়ঙ্কর গরমে মাঠঘাট ফেটে কাঠ। বাড়ির কর্ত্রী ঘরের কাজ সারছিলেন। হঠাৎ লালপাড় শাড়ি পরা এক অচেনা মহিলা ঢুকে পড়েন ঘরে। ক্লান্ত স্বরে বলেন, মা, আমায় একটু জল দেবে? আগন্তুকের অপূর্ব সৌন্দর্যে অভিভূত হয়েছিলেন গৃহকর্ত্রী। খানিক থমকে গিয়েও নিজেকে সামলে তিনি এগিয়ে দিলেন জল। মহিলা ঢক ঢক করে জল খেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় শুধু বলেন, আমি আসি রে, বাইরে ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করছে। তারপরেই মা দুর্গার স্বপ্নাদেশ পান গৃহকর্ত্রী। শান্তিপুরের রায় পরিবারের এই ঘটনা জানে গোটা এলাকা। স্বপ্নাদেশ পেয়েই দুর্গাপুজো শুরু হয় রায়বাড়িতে।
একদা গৌড়বঙ্গের জমিদার ছিল শান্তিপুরের রায় পরিবার। মুঘল আমলে হিন্দু জমিদারদের উপর শুরু হয় অত্যাচার। প্রাণ বাঁচাতে গৃহদেবতা গৌরহরিকে আঁকড়ে জমিদারি ছেড়ে পালান চাঁদ রায় ও গৌরচন্দ্র রায়। আত্মগোপন করেন প্রথমে বাঁশবেড়িয়ায়, পরে গুপ্তিপাড়া হয়ে নদীয়ার বাঘআছড়া এবং শেষে শান্তিপুরে। শান্তিপুরেই স্থায়ী হন। আর্থিক অনটনে দিন কাটছিল। কিছু বছরের মধ্যেই ঘটে সেই অলৌকিক ঘটনা, সপরিবারে রায়বাড়ির দেউড়ি পেরিয়ে আসেন মা দুর্গা। সেই রাতেই স্বপ্নে দেবী জানান, আমি তোর বাড়ি এলাম, চিনতে পারলি না? এবছর থেকেই আমার পুজো কর, মঙ্গল হবে। গৃহকর্ত্রী দ্বিধায় বলেন, দু’ বেলা হাঁড়ি চড়ে না, এত বড় পুজো কেমন করে হবে? শোনা যায়, দেবীর নির্দেশে প্রথম বছর কুলোয় আঁকা ছবিতে পুজো হয়েছিল। সেই থেকে আজও একই রীতি চলছে রায়বাড়ির দুর্গাপুজোয়।
তবে এই পুজোর বিশেষত্ব, দেবী দুর্গার সঙ্গে থাকেন না লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী বা অন্য কোনও দেবদেবীর মূর্তি। পরিবারের বর্তমান কর্তা উজ্জ্বলকুমার রায় বলেন, যেদিন মা এসেছিলেন, তিনি একাই ঢুকেছিলেন। তাই আমাদের পুজোতে একা দুর্গাই থাকেন, সঙ্গে শুধু সিংহ ও অসুর। নবপত্রিকা অবশ্য থাকে। পরিবারের ইতিহাস বলছে, দুর্গাপুজো শুরুর পর থেকেই ভাগ্যের পরিবর্তন হয় রায়দের। শান্তিপুরের অন্যতম প্রধান জমিদার পরিবারে পরিণত হন তাঁরা। আজও তার নিদর্শন আট থানের সুবিশাল দালান, যা বাংলার বাকি জমিদার বাড়িগুলির মধ্যে বিরল। আপাদমস্তক শাক্তমতে পুজো হলেও বলি হতো না। বরাবরই ফলবলি দিয়ে তা দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। শান্তিপুরের গৌরহরি রোডের এই রায় জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো তাই শুধু প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষী নয়, ভক্তদের কাছে আকর্ষণীয়ও।