বিপ্লবীদের ডেরা অম্বিকানগর রাজবাড়ির পুজো হয় অনুদানে, আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে রাজ্য ও স্থানীয়রা
বর্তমান | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
রঞ্জুগোপাল মুখোপাধ্যায়, বাঁকুড়া: রাজতন্ত্রের অবসান হয়েছে বহুকাল আগেই। রাজ্যপাটও আর নেই। এখন যেটা রয়েছে সেটা কেবল একটা জীর্ণ প্রাসাদ। ইতিহাসের ভাঙাচোরা উঠোন। রাজ-রাজাড়াদের কাহিনি থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস—অম্বিকানগর রাজবাড়ি। সেই রাজমহিমা এখন অস্তমিত। রাজ ঐতিহ্যের সাক্ষী উমার আরাধনাকে বাঁচিয়ে রাখতে পরিবারের সদস্যকে ভরসা করতে গণতান্ত্রিক সরকারের অনুদানের উপর। রাজের সাহায্য নেওয়া পাশপাশি ইতিহাসকে রক্ষা করতে চাঁদা দেন গ্রামবাসীরাও। তাই হয়তো রাজতন্ত্রের পতনের পর আজও রাজাদের দুর্গোৎসবে মাতোয়ারা থাকে কংসাবতী জলাধারের পাশের জনপদ।
তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ গোটা দেশে। অম্বিকানগরের তৎকালীন রাজা রাইচরণ চুপচাপ বসে থাকতে পারেননি। সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন তিনি। ফলে, রাজবাড়ি হয়ে উঠেছিল বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা। প্রতিবছর পুজোয় সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন বাংলার বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী। সে সব আজ ইতিহাসের পাতায়। রাজকীয় জৌলুস হারিয়েছে দশভুজার পুজোও। এখন স্রেফ ধূপ-ধূনোর সুবাসটুকু সম্বল করে আভিজাত্যের ধারা বয়ে নিয়ে চলেছেন রাজবংশের বর্তমান সদস্যরা।
আজ থেকে প্রায় ৪১৪ বছর আগে কাঁসাই ও কুমারী নদী ঘেরা খাতড়া মহকুমার ওই জনপদে রাজা খর্গেশ্বর পুজোর সূচনা করেছিলেন। বর্তমানে সেই পুজো রাজবাড়ির গণ্ডি ছাড়িয়ে গোটা অম্বিকানগর গ্রামের। প্রতিবছর পুজোর ক’টা দিন রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠেন দক্ষিণ বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল রানিবাঁধের প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দারা।
অম্বিকানগর রাজ পরিবারের পূর্বপুরুষরা ছিলেন রাজস্থানের ঢোলপুরের বাসিন্দা। সেখান থেকে তাঁরা এসে খাতড়ার সুপুর এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। সুপুরে বসবাসের সময় রাজ পরিবারের অন্দরে ধন-সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ বাধে। তার জেরে পরিবার দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। দশ আনা ও ছ’আনা হিসেবে মোট সম্পত্তি ভাগ হয়। ছ’আনার ভাগীদাররা অম্বিকানগরে গিয়ে রাজ্যপাট শুরু করেন। রাজ পরিবারের কূলদেবতা কালাচাঁদ, কূলদেবী অম্বিকা। কথিত, কূলদেবীর নাম অনুসারে গ্রামের নাম হয় অম্বিকানগর। বাঁকুড়ার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র মুকুটমণিপুর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার গেলেই অম্বিকানগর। রাজা কালাচাঁদ ধবলদেওর দৌহিত্র গৌরীশঙ্কর নারায়ণদেও বর্তমানে রাজ পরিবারের পুজো দেখাশোনা করেন। তাঁর উদ্যোগেই রাজবাড়ির কিছু অংশের সংস্কার হয়েছে। বৃহস্পতিবার তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের পুজো ১৬১১ সালে শুরু। তার মানে ৪১৪ বছর ধরে পুজো হয়ে আসছে। আগের মতো এখনও একচালার সাবেকি প্রতিমাতেই দেবী পুজিতা হন। রানিবাঁধ থানা এলাকার মধ্যে প্রথম এই রাজবাড়িতেই দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। ষষ্ঠীর দিন দেবীর অধিবাসে কালচাঁদ জিউর মন্দিরের সামনে যজ্ঞ হয়। ওই যজ্ঞের অঙ্গার দিয়ে মায়ের চোখের কাজল তৈরি হয়। ঠাকুর দালানে যজ্ঞের আগুন সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত দিবারাত্র জ্বলতে থাকে। নবমীতে ওই যজ্ঞে আহুতি দেওয়া হয়। রীতি অনুযায়ী পুজোর চারদিন মায়ের ঘটের সামনে নামানো থাকে প্রাচীন আমলের ‘দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ’। ওই শঙ্খের জল ঘটে দেওয়া হয়।’ কথা বলতে বলতে গৌরীশঙ্করবাবু বার বার ফিরে যাচ্ছিলেন শৈশবে। স্মৃতির মণিকোঠায় ঘা মেরে বলছিলেন, ‘আমাদের যখন রাজ্যপাট ছিল তখন পুজোর জৌলুস ছিল দেখার মতো। পুজোর অনেক আগে থেকেই রাজবাড়িতে উৎসব শুরু হয়ে যেত। নানা জায়গা থেকে লোকজন আসত। এখন আর সেই জাঁকজমক নেই। রাজ্য সরকারের আর্থিক অনুদান আমরা শুরু থেকেই পাচ্ছি। ওই টাকা পাওয়ার ফলে অনেকটাই সুরাহা হয়েছে। অম্বিকানগর ও আশাপাশের গ্রামের বাসিন্দারাও পুজো চালাতে সাহায্য করেন। বাকিটা আমরা দিয়ে থাকি।’