সত্যজিতের ছবি করতে গিয়ে অবাক হলাম, আমি এতটা পারি সেটা আমিই জানতাম না: জহর রায়
আনন্দবাজার | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
জুলজুলে দৃষ্টির শীর্ণকায় সিড়িঙ্গে এক লোকের বুভুক্ষু নজরে পুরুষ্টু একটি মুর্গির ঠ্যাং। পেশায় গুপ্তচর লোকটি একটু দূর থেকে কিম্ভূত দৃষ্টিলালসায় ঠ্যাংটির দিকে তাকিয়ে। কিন্তু, ওই দৃষ্টিক্ষুধাটুকুই বেচারার সার প্রাপ্তি! এক সময় সে কুণ্ঠার সঙ্গে বলে, ‘অনেকদিন খাইনি হুজুর।’ সে কথা শুনে সিংহাসনে উপবিষ্ট নধর মন্ত্রী মহোদয় রাজকীয় খাবারের থালা থেকে সেই ঠ্যাংটি তুলে, তাতে প্রকাণ্ড কামড় বসিয়ে বলে ওঠেন, ‘তোমাদের সারাক্ষণ এত খাই-খাই কেন বলো তো’! চকিতে অভুক্ত লোকটির সম্বিৎ ফেরে। তার মনে পড়ে, সে এমনই এক হতচ্ছাড়া দেশের হতভাগ্য নাগরিক, যেখানে আধপেট থাকলে বা খাওয়া না জুটলেও খাজনা বাকি রাখা সর্বতোভাবে না-মঞ্জুর।
বর্ণনাটি কোথাকার, তা বলতে পারার জন্য কোনও পুরস্কার নেই। এমনকি, বর্ণিত দৃশ্যটিতে যে নিষ্ঠুরতার কৌতুকাভাস বিবৃত হয়েছে, তাতেও নেই কোনও ‘অজ্ঞাতপূর্বের চমক’। অভুক্তকে নিয়ে এরকম নিস্পৃহ রসিকতার মধ্যে দিয়ে সামাজিক বৈষম্যকে তুলে ধরার উদাহরণ অনেক রয়েছে। তবে, এখানে যেটা বলার সেটা হল, কী ভাবে অভিনয়ের মাধ্যমে সেই বিসদৃশ কৌতুক ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির পূর্ণতর কাহিনির অবিচ্ছেদ্য মুহূর্ত হয়ে ওঠে। মন্ত্রীরূপী জহর রায়ের সংলাপটি বলার অননুকরণীয় ধরন ও উল্টো দিকে মন্ত্রীর অভিযোগ শুনে চিন্ময় রায়ের কুণ্ঠা-ক্লিষ্ট প্রতিক্রিয়া— জুড়িদারি অভিনয়ের এ হেন ‘পারফেকশন’ কমই দেখা যায়। আবার ওই ছবিতেই দেখা যায় হাল্লার রাজা সন্তোষ দত্তের সঙ্গে মন্ত্রী জহরের বাচনভঙ্গি, গায়নভঙ্গি এবং নাচনভঙ্গির ত্র্যহস্পর্শী তামাশা!
গত শতাব্দীর তিন ‘আইকনিক’ বাঙালি কৌতুকাভিনেতার মধ্যে একজন জহর রায়। সেই ত্রয়ীর দু’জন তুলসী চক্রবর্তী এবং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জহরেরও অভিনয় এবং ভাঁড়ামির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ছিল। এর একটা উদারণ দেখি অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিতে। হাড়ভাঙা গ্রামের দাপুটে জমিদার গোবর্ধন চৌধুরীর ভূমিকায় ফুটবল মাঠে তাঁর হম্বিতম্বি, কূটকচাল, মায় লাঠির বাঁকানো বাঁট বাগিয়ে বিরোধী খেলোয়াড়ের ঠ্যাং ধরার অপচেষ্টা দেখে আমরা বিস্তর আমোদ লাভ করি। কিন্তু সেই মুহূর্তটি মনে করুন, হাড়ভাঙা টিমের বিপর্যয়ের পর ঘুঁটের মালা পরে তাঁর আঁকুপাকু বিলাপের সময়ে যখন হরিধন মুখোপাধ্যায় তাঁর কানে-কানে গোপন ষড়যন্ত্রের শলা দিচ্ছেন, সেই মুহূর্তে জহরের প্রতিক্রিয়া। নিমেষে মড়াকান্না থামিয়ে সিরিয়াস মুখে ‘পারতেই হবে, পারতেই হবে’ বলে উঠে পাশের ঘরে যাওয়া। ক্ষণে ক্ষণে অভিব্যক্তি পাল্টানো, বিশেষ করে বিপরীত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা অভিনয়শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ। এই দক্ষতা জহর ব্যবহার করতেন তাঁর নিজস্ব ধরনে। প্রায় নিস্পৃহ উদাসীন মুখে কণ্ঠস্বরের ‘মডিউলেশন’ ঘটিয়ে কমিক মুহূর্ত তৈরি করা ছিল ওঁর কাজের ট্রেডমার্ক। নিজেই দাবি করতেন, অভিনয় তিনি শিখেছেন একজনের কাজ দেখে। তিনি চার্লি চ্যাপলিন।
‘‘জহর রায় নামটা শুনলেই মনে একটু খোঁচা লাগে। অনেক করুণ মুখেও একটু হাসির রেখা দেখা যায়। আমি ঘন ঘন রুমাল দিয়ে মুখ মুছি আর মনে মনে ভাবি, আমাকে দেখেই ওরা হাসে কেন? আমার দেহের প্রতি স্তরে স্তরে কি হাসির ম্যাগনেট লাগানো আছে? আমি জানি, মানুষকে হাসাতে পারা আমার কৃতিত্ব, যতদিন হাসাতে পারব ততদিনই আমি জহর রায়। তারপর হব ইতিহাস। যেমন হয়েছে গোপাল ভাঁড়।’’
১৯৬১ সালে এক সিনেমা পত্রিকার পূজা সংখ্যায় ‘ওদের হাসাতে পারিনি’ শিরোনামের একটি লেখায় এ-ভাবেই নিজের মূল্যায়ন করেছিলেন জহর রায়। পাশাপাশি, নিজের লিগ্যাসি সম্পর্কেও তাঁর ধারণা ছিল নির্মোহ। গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি কৌতুকাভিনয়ের অন্যতম ‘আইকন’ জহর নিজেকে মনে করতেন ‘এ যুগের ভাঁড়’। শ্রোতা-দর্শকের সঙ্গে কোন স্তরে তাঁর সংযোগ ঘটত, উপরোক্ত লেখায় সেটাও স্পষ্ট করেছেন তিনি। ‘‘...অজস্র সুখ-দুঃখের মধ্যে মানুষ আমাকে দেখে হাসে, এটাই আমার মূলধন। (অনুষ্ঠান মঞ্চে) দর্শকেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন শিল্পীদের আগমন পথের দিকে। একে একে শিল্পীদের আবির্ভাব ঘটছে, আর দর্শকদের উত্তেজনা স্তিমিত হচ্ছে। হঠাৎ দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা গেল, ‘হেমন্ত আসছে’। একটু পরেই শোনা গেল, ‘শ্যামল আসছে’।... আমাকে দেখেই দর্শকদের চাপা উত্তেজনা শোরগোল হয়ে উঠল।... সবাই বলছে, ‘শালা জহর’! ঝিমিয়ে পড়া মানুষগুলোর মুখে হাসির ঝলক। ওই ওদের মুখের ‘শালা’টা আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার’।’’
জহর রায়ের জীবন-কাহিনি পড়লে মনে হয়, কৌতুকাভিনয়ের জন্য এক সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও তাঁর জীবনের রাস্তাটা কোনওদিনই খুব মসৃণ হয়নি। ১৯১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বরিশালে তাঁর জন্ম। পিতা সতু রায় নির্বাক যুগে কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করলেও পেশাদারি সাফল্য পাননি। মঞ্চাভিনয় করেছেন শিশির ভাদুড়ির দলেও। প্রথমে কলকাতা এবং পরে পটনায় পাড়ি দেন জীবিকার প্রয়োজনে। জহর রায়ের বাল্যজীবন কেটেছে কলকাতায়। নারকেলডাঙা হাইস্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। তার পরে বাবার সঙ্গে যান পটনায়। সেখানে রামমোহন রায় সেমিনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৯৩৬ সালে। পটনার বিএন কলেজে থেকে ১৯৫৮ সালে আইএ পাশ করার পর বিএ পড়তে ঢুকেও ছেড়ে দেন। কমলা দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয় ১৯৫৪ সালে। জহর রায় কলকাতায় প্রথমে থাকতেন পটুয়াটোলায় ‘অমিয় নিবাস’ নামে একটি মেসবাড়ির দুটি ঘর নিয়ে। পরে পরিবার নিয়ে আলাদা বাড়িতে উঠে গেলেও ওই মেসের ঘর কখনওই ছাড়েননি। সেখানে ছিল তাঁর অফিস এবং সুবিশাল লাইব্রেরি। তাঁর মৃত্যুর পরে সেই লাইব্রেরির বহু বই পুরনো বইয়ের দোকানে বিক্রি হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলি, বর্তমান লেখকের কাছেও জহর রায়ের গ্রন্থভান্ডারের দুটি বই, অভিনেতার সই-সমেত, গ্রোভ প্রেস প্রকাশিত স্যামুয়েল বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গোডো’-র প্রথম ইংরেজি সংস্করণ এবং এডোয়ার্ড অলবি’র ‘হুজ অ্যাফ্রেড অফ ভার্জিনিয়া উলফ’-এর প্রথম পেপারব্যাক সংস্করণ রয়েছে। উক্ত বই দু’টি সেই পুরনো বইয়ের দোকান থেকেই খরিদ করা।
ছেলেবেলা থেকে অভিনয়ে আগ্রহ থাকলেও জহর রায় সেটাকে পেশা হিসাবে নেওয়ার কথা ভেবেছেন অনেক পরে। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘সিরিয়াস রোলে অভিনয় করতে হলে ১৯৪৭ সালে আর আমাকে অভিনয় জগতে আসতে হত না। লাইন দিয়ে বসে থেকে ১৯৬৭ সালেও চান্স পেতাম কি না সন্দেহ। বাবা ও জ্যাঠামশাইয়ের কাছে সিরিয়াস ও লাইট— দু’রকম অভিনয়েই হাতেখড়ি হয়েছিল। প্রথম যৌবনে পটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রুফ রিডারের চাকরি, তার পরে একটা নামকরা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি এবং অবশেষে দর্জির দোকান দিয়ে ব্যবসা। দাঙ্গায় আরপুলি লেনে অবস্থিত আমার দর্জির দোকানটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হলে অভিনয়কেই যখন পেশা হিসাবে গ্রহণ করব ঠিক করলাম, তখন দেখলাম বাংলা সিনেমায় কমেডিয়ানদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।’’
অভিনয়কেই পেশা করবেন মনস্থির করে জহর যোগাযোগ করেন পূর্বপরিচিত পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ‘পূর্বরাগ’ (১৯৪৭) ছবিতে একটি কৌতুকাভিনয়ের সুযোগ পান। প্রায় একই সময় সুশীল মজুমদারের ‘সাহারা’ ছবিতে কাজ করলেও ‘পূর্বরাগ’ই তাঁর প্রথম মুক্তি পাওয়া ছবি। তবে, দর্শকের নজরে তিনি প্রথম আসেন নির্মল দে’র ‘বসু পরিবার’ (১৯৫২) ছবির সূত্রে, এক সুদখোর পাওনাদারের চরিত্রে অভিনয় করে। ত্রিশ বছরের পেশাদারি অভিনয়জীবনে ৩০০-র বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন জহর (প্রসঙ্গত, দোলা চৌধুরির সাল ধরে করা জহর রায় অভিনীত চলচ্চিত্রপঞ্জিতে মোট ৩১১টি ছবির হদিস মেলে)।
স্থায়ী ভাবে মঞ্চাভিনয় শুরু ১৯৫৫ সালে, রঙমহলে ‘দূরভাষিণী’ নাটক দিয়ে। রঙমহলের যখন প্রায় উঠে যাওয়ার অবস্থা, জহর রায়ই এগিয়ে আসেন নাট্যমঞ্চটি বাঁচিয়ে রাখতে। প্রায় দুই দশক ধরে ধারাবাহিক ভাবে ‘শেষ লগ্ন’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘নহবৎ’, ‘টাকার রঙ কালো’, ‘সেমসাইড’, ‘আমি মন্ত্রী হব’, ‘বাবা বদল’, ‘সুবর্ণ গোলক’, ‘অনন্যা’র মতো একের পর এক মঞ্চসফল নাটক করে গিয়েছেন। ‘উল্কা’ নাটকে হোটেল ম্যানেজার ‘তুপে’র ভূমিকায় সাড়া ফেলেছিলেন জহর। এ-সবের পাশাপাশি চুটিয়ে করেছেন বেতার নাটক (যদিও অডিশনে পাশ করেননি) এবং কৌতুক-নকশার বহু রেকর্ড। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ‘ন্যাপাসুর বধ’। এক বার মঞ্চে ‘ন্যাপাসুর বধ’ শুনে দর্শকাসনে বসা সত্যজিৎ এমন হেসেছিলেন যে, সেটা নিয়েও রয়েছে আলাদা গল্প। সত্যজিতের মুখ খুলে ‘হো হো’ হাসি শুনে একজন আলোকচিত্রী তাঁর মুখেরই একটি ছবি তোলেন। তাতে সত্যজিতের গলার ভিতর অবধি ধরা পড়েছিল। জহর মজা করে বলতেন, কেউ সত্যজিতের আলজিভ দেখতে চাইলে তাকে ওই ছবিটা দেখতে হবে! সত্যজিতের দু’টি ছবিতে কাজ করেছেন জহর। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছাড়া ‘পরশ পাথর’-এ পরেশবাবু তুলসী চক্রবর্তীর পরিচারকের ভূমিকায় একটি ছোট রোলে কাজ করেছিলেন জহর। প্রায় সংলাপহীন সেই চরিত্রে জহর শুধু শরীরের মুভমেন্ট ব্যবহার করেই কেল্লা ফতে করেছিলেন। একবার সত্যজিৎ তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘‘জহরবাবু, আপনি তো বয়সে আমার চেয়ে বড়। আমায় মানিকদা বলেন কেন?’’ ঝটিতি উত্তর ছিল, ‘‘আমি আপনার চেয়ে এজে বড়, কিন্তু আপনি আমার চেয়ে ইমেজে বড়।’’
জহর রায় সম্পর্কে পুরনো লেখাপত্র ঘাঁটতে গিয়ে দেখেছি, অনেকেই প্রশংসা করেছেন তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও কথার পিঠে কথা সাজানোর প্রতিভাকে। বলা বাহুল্য, কমেডি অভিনেতার পক্ষে এই গুণ বিশেষ সহায়ক। কিন্তু, সেটা মাত্রাছাড়া হলে চলচ্চিত্র বা নাটকে এর কুফলও দেখা যায়। যেখানে অভিনেতা চরিত্রকে স্বতঃস্ফূর্ত করে তোলার বদলে ইম্প্রোভাইজ়েশনের নামে বাড়াবাড়ি করেন। সত্যজিৎ রায়, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়দের মতো দক্ষ পরিচালকের ছবিতে জহর রায়ের অভিনয়ের যে সূক্ষ্মতা দেখা যায়, অনেক ছবিতেই তা অনুপস্থিত। বোঝাই যায়, পরিচালক নেহাত পরিকল্পনাহীন কমিক রিলিফের জন্য জহর রায়কে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়েছেন, এবং প্রত্যাশিত ভাবে তিনি সেটাই করে চলেছেন। মনোজ মিত্র রচিত ‘কেনারাম বেচারাম’ নাটকটির নাম পাল্টে ‘বাবা বদল’ নাম দিয়ে রঙমহলে করতেন জহর রায়। সঙ্গে হরিধন মুখোপাধ্যায়, অজিত চট্টোপাধ্যায়ের মতো ডাকসাইটে অভিনেতারা। মনোজ মিত্রেরই একটি লেখায় রয়েছে সেই অদ্ভূত অভিজ্ঞতা। নাটকের কোনও দৃশ্যে জহর রায়ের বিশ্রামপর্ব। তখনই বাকি অভিনেতারা নাটকের সঙ্গে সংশ্রবহীন সংলাপ দিয়ে মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন। তা দেখে তাজ্জব মনোজবাবু জহর রায়ের ঘরে গিয়ে অভিযোগ জানাতেই তিনি হই হই করে ওঠেন। এদের হাততালি পাওয়া বার করছি বলে সোজা ঢুকে পড়েন মঞ্চে! সহ-অভিনেতারা মুহূর্তের জন্য হতবাক। কিন্তু পোড়খাওয়া, অতি-দক্ষ অভিনেতারা পরমুহূর্তেই সমবেত ভাবে তাৎক্ষণিক সংলাপ বা ‘অ্যাড লিব’ দিয়ে নাটক ‘এগিয়ে’ নিয়ে যেতে থাকেন। মনোজবাবুর বর্ণনায়, ‘‘ধানীপটকা কালী পটকা দোদমার মতো কথারা অনর্গল ছুটছিল ফাটছিল। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ শিহরিত, রোমাঞ্চিত, চমৎকৃত। আওয়াজে মনে হচ্ছিল গোটা হল লুটোপুটি খাচ্ছে।... সেদিন পর্দা পড়তেই সম্মিলিত কণ্ঠের দাবি, এরপর থেকে এই অভিনব দৃশ্যটা রাখতেই হবে নাটকে।... সেই রাত্রির পরে আমি আর রঙমহলে ঢুকিনি। জহর রায়ের ডাকে আর কোনওদিন অমিয় নিবাসে যাইনি। ওই রকম একটা রোমহর্ষক কাণ্ড যা কিনা এক ধাক্কায় গোটা নাটকটাই লন্ডভন্ড করে দেয়, কোনও মানুষ যে ঠান্ডা মাথায় ঘটাতে পারেন, চোখের ওপর না দেখলে বিশ্বাস হতো না।’’
এই বর্ণনায় অবশ্যই জহর রায়ের পুরো চরিত্র ধরা পড়ে না। মনোজ মিত্র ওই লেখারই উপসংহারে লিখেছেন, ‘‘জহর রায় যে একজন উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রের মানুষ ছিলেন, তা-ও মানতে পারি না। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহদের ছবিতে অমন সব সর্বজনপ্রিয় কালজয়ী অভিনয় কী গভীর শৃঙ্খলাবোধ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ ব্যতীত সম্ভব? শিক্ষাদীক্ষা, রুচি, শিল্পসাহিত্য বোধ, নতুন কিছু গড়ার আবেগ এবং সর্বোপরি অভিনয় ভালবাসায় তাঁর কখনও কোনও খামতি দেখা যায়নি।’’
লরেল-হার্ডির মতোই বাংলার দর্শকের কাছে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ভানু-জহর জুটি। বস্তুত, এঁদের ছাড়া আর কোনও অভিনেতার নাম দিয়ে ছবি— ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’, ‘এ জহর সে জহর নয়’ করার মতো ঘটনা বাংলায় সম্ভবত আর হয়নি। প্রচুর কাজ করলেও, শোনা যায়, জহর রায় কাজ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও বাছবিচার করতেন না। একটা পর্বে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যে-রকম বেছে কাজ নেওয়ার পক্ষপাতী হয়েছিলেন, জহরের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। আবার উপার্জনের বিষয়েও তিনি মাথা ঘামাতেন না। যে আমলে ভানুর দৈনিক রেট ছিল আড়াইশো-তিনশো টাকা, জহর পঁচাত্তর-আশি টাকাতেও কাজ করতেন! এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর মদ্যপান। ধর্মতলার একটি বিখ্যাত পানশালায় প্রায় রোজই সন্ধ্যায় তিনি বসতেন। এ-ব্যাপারে তাঁর যুক্তি ছিল, পেটে দু-পাত্তর না-পড়লে নতুন কৌতুক-নকশার আইডিয়া খেলে না। তবে তিনি অপরিমিত মদ্যপায়ী ছিলেন কি না, সে-বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট সাক্ষ্য পাওয়া য়ায় না। মাধবী মুখোপাধ্যায় অবশ্য তাঁর স্মৃতিচারণে জহর রায়ের অসুস্থতা এবং শরীর ভেঙে যাওয়ার কারণ হিসাবে মদ্যপানকেই দায়ী করেছেন।
মদ্যপের ভূমিকায় জহর রায়কে আমরা দেখি ঋত্বিকের ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ (১৯৭৭) ছবিতে, ছোট একটি ক্যামিও রোলে। সানুনাসিক স্খলিত কণ্ঠে ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায়’ শ্যামাসঙ্গীতটি গাইতে গাইতে একটি মালবোঝাই গরুর গাড়ির পিছনে ছুটতে ছুটতে তিনি আছাড় খান একটি কালভার্টের উপরে। উঠে নিজেকে একটু ঝেড়েঝুড়ে নিতে-নিতেই মোলাকাত হয় নীলকণ্ঠ-নচিকেতা-বঙ্গবালার সঙ্গে। নীলকণ্ঠ স্থানীয় মেয়েদের স্কুলের ঠিকানা জানতে চাইলে জহর যে-ভাবে রেকারিং ডেসিমেলের মতো ‘ডাইনে-বাঁয়ে, ডাইনে-বাঁয়ে’ চালাতে থাকেন, সেটা ছবির মূল বক্তব্যের সঙ্গে খাপ খায় অনায়াসে।
১৯৭৭ সালের ১ অগস্ট হাসপাতালে মৃত্যু হয় জহর রায়ের। আড়ম্বরহীন শয্যায় সাদা কাপড়ে ঢাকা নিথর সহশিল্পীকে দেখে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ভেঙে পড়ে বলেছিলেন, এমন একজন অভিনেতার শেষ বিদায়ে এ ভাবে হয়! বিলেত হলে অন্তত ‘স্যর’ উপাধি পেতেন জহর। তাঁর অন্তিম যাত্রায় এসেছিলেন সুচিত্রা সেন। মরদেহের কপালে চুমু খেয়ে মৃদুকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘‘তুমি চলে গেলে চার্লি!’’
নিজেকে ‘এ-যুগের ভাঁড়’ বলে দাবি করলেও জহর রায় কি নিছকই ভাঁড়ামিতে নিমজ্জিত শিল্পী? দুঃখের কথা, আপন প্রতিভার তুলনায় কাজের সুযোগ তিনি কমই পেয়েছেন। এ নিয়ে সচেতন ছিলেন নিজেও। নইলে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবি করা পর কেনই বা তাঁকে বলতে শোনা যাবে, ‘‘অধিকাংশ বাঙালি পরিচালকের কমিক সেন্স বলে কিছু নেই। তাঁরা হাসতে হাসতে কী ভাবে ভাবাতে হয় সেটা জানেন না। তা ছাড়া সিনেমায় কমেডি ব্যাপারটা ভারি শক্ত।... সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে এই ভেবে অবাক হলাম যে, আমি এতটা পারি সেটা আমিই জানতাম না।’’
তথ্যসূত্র: পুরনো ‘উল্টোরথ’ ও ‘চিত্রভাষ’ পত্রিকার কয়েকটি সংস্করণ। বিশেষ করে ২০২৪ সালে প্রকাশিত চৌরঙ্গী সাহিত্য সংস্কৃতি পত্রিকার ‘শতবর্ষে জহর রায়’ সংখ্যা।