পাঞ্জাব ফুঁসছে বিয়াস, তাণ্ডব শতদ্রুর! ক্ষতির পরিমাণ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি...
আজকাল | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে বিপর্যস্ত পাঞ্জাব। রাজ্যের জলসম্পদ মন্ত্রী বরিন্দর কুমার গয়াল জানিয়েছেন, এ বছর আগস্টের শেষ সপ্তাহে প্রবল বর্ষণ ও নদীর উপচে পড়া জলে পাঞ্জাব প্রায় ১৩,৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি বহন করেছে। ক্ষতির অঙ্ক আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বন্যায় এ পর্যন্ত অন্তত ৫৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন, বহু গৃহপালিত পশু মারা গেছে, আর প্রায় ৪.৫ লাখ একর চাষের জমি জলে তলিয়ে গেছে।
এই ভয়াবহ বন্যার অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে পাঠানকোট জেলার মধ্যপুর ব্যারাজের ফ্লাডগেট ভেঙে পড়া। ২৭ আগস্ট লাগাতার বৃষ্টির মধ্যে ব্যারাজের দুটি ফ্লাডগেট ভেঙে যায়। এর ফলে জলসম্পদ দপ্তরের এক কর্মীর মৃত্যু হয়; তাঁকে রবি নদীর প্রবল স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রাজ্য সরকার জানিয়েছে, লেভেল ৯ বিজ প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি সংস্থা গত ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে রিপোর্ট দিয়েছিল যে ব্যারাজের সব ফ্লাডগেট ভালো অবস্থায় রয়েছে। অথচ বাস্তবে তা ছিল না। এই প্রেক্ষিতে সংস্থার বিরুদ্ধে শোকজ নোটিশ জারি হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যারাজের রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতির অভিযোগে দায়ী সরকারি কর্মীদের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়েছে।
পাঞ্জাবের তিন প্রধান নদী—শতদ্রু, বিয়াস ও রবি—মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে রবি। জলসম্পদ দপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, এ বছর এককভাবে রবি নদীই রাজ্যের ৮৫ শতাংশ বন্যার কারণ। পাঠানকোট, গুরুদাসপুর ও অমৃতসর জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।শতদ্রু ও বিয়াসও উথলে ওঠে এবং ফেরোজপুর, ফাজিলকা, তারনতারন, কপূরথলা, হোশিয়ারপুর, রূপনগর, মানসা ও মোগা জেলাতেও জল ঢোকে। তবে রবি নদীর জলোচ্ছ্বাসই ছিল সর্বাধিক বিধ্বংসী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রবি নদীর নিরাপদ বহনক্ষমতা ৯.৭ লক্ষ কিউসেক হলেও, এ বছর নদীতে প্রবাহ হয়েছে ১৪.১১ লক্ষ কিউসেক, যা গত ১৯৮৮ সালের বন্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে রণজিত সাগর বাঁধ থেকে ছাড়ানো জল ছিল ২.১৫ লক্ষ কিউসেক, কিন্তু আসল বিপদ তৈরি করেছে জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ ও পাকিস্তান থেকে আসা ছোট ছোট খাল-বিল ও নালার বন্যাধারা।
ভারতীয় আবহাওয়া দফতরের (IMD) পূর্বাভাসও এবার বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। ২৪ থেকে ২৬ আগস্টের মধ্যে রণজিত সাগর বাঁধ এলাকায় পূর্বাভাসের তুলনায় ছয়-সাত গুণ বেশি বৃষ্টি হয়। ২৪ আগস্ট যেখানে ২১ মিমি বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল, সেখানে হয় ১৬৩ মিমি। একইভাবে ২৫ আগস্ট ১৮ মিমি’র বদলে হয় ১৪৭ মিমি। ২৭ আগস্ট ৫ মিমি পূর্বাভাস দেওয়া হলেও প্রকৃত বৃষ্টি হয় ৯০.৫ মিমি। রাজ্য সরকার অভিযোগ করেছে, সময়মতো ও সঠিক আবহাওয়া পূর্বাভাস না থাকায় বাঁধ থেকে জল ছাড়ার সিদ্ধান্তে দেরি হয়, ফলে বিপর্যয় আরও বাড়ে।
মন্ত্রী বরিন্দর কুমার গয়াল কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা ২০,০০০ কোটি টাকার বিশেষ ত্রাণ চেয়েছিলাম। কিন্তু কেন্দ্র মাত্র ১,৬০০ কোটি টাকার সাহায্য ঘোষণা করেছে। এত বিপুল ক্ষতির পর এটি অত্যন্ত অপ্রতুল।” তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান বন্যার জন্য অবৈধ বালি খননকে দায়ী করেছেন, কিন্তু রবি নদীর সীমান্তবর্তী এলাকায় এমন খনন হয় না। এ ধরনের মন্তব্য বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
রাজ্য সরকার জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত নদী ও খালগুলোর উপর বিশেষ সমীক্ষা চালানো হচ্ছে। নদীবাঁধ মজবুত করা, বাঁশের তৈরি প্রতিরক্ষা কাঠামো (bamboo porcupines) বসানো এবং নতুন জলনিয়ন্ত্রণ প্রকল্প নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। একই সঙ্গে জম্মুর উঝ নদীতে বহুদিনের পুরনো বাঁধ নির্মাণ প্রস্তাবও আবার আলোচনায় আনা হবে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পাঞ্জাবের বন্যার ধরণ ও তীব্রতা বাড়ছে। ২০১৯, ২০২৩ ও ২০২৫ সালে ধারাবাহিকভাবে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। এ অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।
পাঞ্জাবের সাবেক প্রধান ইঞ্জিনিয়ার অমরজিৎ সিং দুল্লেত বলেন, “প্রায় ৭০ শতাংশ বন্যাই মানুষের গাফিলতির কারণে ঘটেছে। মধ্যপুর হেডওয়ার্কসের গেট ভেঙে পড়া স্পষ্ট করে যে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী জল ছাড়ার ‘রুল কার্ভ’ মেনে চলা হলেও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা না করায় বিপর্যয় বেড়েছে।” তিনি রাজ্য সরকারকে দোষী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ বছরের বন্যা শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং সরকারি গাফিলতি, ভ্রান্ত আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং নদী ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার সম্মিলিত ফল। পাঞ্জাবের খাদ্যশস্য উৎপাদন, কৃষক জীবিকা এবং রাজ্যের সামগ্রিক অর্থনীতি এখন এক গভীর সংকটে দাঁড়িয়ে।