সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্নেহাশীষ ভট্টাচার্যের চাকরিচ্যুতি নিয়ে বিতর্ক...
আজকাল | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয় (South Asian University – SAU) আবারও তীব্র বিতর্কের মুখে পড়ল। অর্থনীতির অধ্যাপক স্নেহাশীষ ভট্টাচার্য, যিনি ২০১১ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন, তাঁকে ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ চূড়ান্তভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই চাকরিচ্যুতি কার্যকর বলে ঘোষণা করা হয়েছে ১৬ জুন ২০২৩ থেকে, অর্থাৎ যেদিন তাঁকে প্রথমবার সাসপেন্ড করা হয়েছিল।
প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানোই অপরাধ?
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্টাইপেন্ড কমানো ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটিতে ছাত্র প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তির দাবিতে আন্দোলনে নামে। ওই সময় অধ্যাপক ভট্টাচার্যসহ কয়েকজন শিক্ষক প্রকাশ্যে ছাত্রদের পক্ষে প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে মত দেন।
কিন্তু প্রশাসন পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। ১৩ অক্টোবর ২০২২-এ ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকা হয় এবং ৪ নভেম্বর পাঁচজন ছাত্রকে সাসপেন্ড করা হয়। এই ঘটনার পরদিন ভট্টাচার্য ও আরও ১২ জন শিক্ষক প্রশাসনের পদক্ষেপের বিরোধিতা করে চিঠি লেখেন। পরে তিনি আরও একটি ইমেইলে, ১৫ জন শিক্ষকের সহস্বাক্ষরে, প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে "অবৈধ ও স্বেচ্ছাচারী" বলে অভিহিত করেন।
২০২৩ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয় একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি ভট্টাচার্যসহ চার অধ্যাপকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তাঁদের শতাধিক প্রশ্নের লিখিত উত্তর একই দিনে দিতে বলা হয়, যা তাঁরা অস্বীকার করেন। সেপ্টেম্বরে প্রত্যেককে একাধিক অভিযোগে চার্জশিট দেওয়া হয়—ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে ছিল ৫২টি অভিযোগ।
তবে তদন্তের প্রক্রিয়া নিয়েই গুরুতর প্রশ্ন ওঠে। ভট্টাচার্যকে কমিটির কার্যপ্রণালী বা শর্তাবলি জানানো হয়নি। অনেক অভিযোগ প্রশাসনের প্রোক্টরের সিদ্ধান্তের বিরোধিতামূলক ইমেইল থেকে নেওয়া হয়েছিল। ২০২৫ সালের আগস্টে তাঁকে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়, কিন্তু তদন্ত কমিটির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তখনও হাতে পৌঁছায়নি। তবু প্রশাসন তাঁর উত্তরকে "অসন্তোষজনক" আখ্যা দিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত নেয়।
একই মামলায় আইনের অধ্যাপক শ্রীনিবাস বুরা ও সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবি কুমার পরে ক্ষমাপ্রার্থনা করে চাকরিতে ফিরলেও ভট্টাচার্য এবং সমাজবিজ্ঞানেরই ইরফানুল্লাহ ফারুকিকে চূড়ান্তভাবে বাদ দেওয়া হয়। ফারুকির চুক্তি নবীকরণও আটকে দেওয়া হয়। ভট্টাচার্য দিল্লি হাইকোর্টে সাসপেনশনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। কিন্তু ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আদালত রায় দেয় যে এসএউ-র ক্ষেত্রে তাদের এখতিয়ার নেই। যদিও একই আদালত ছাত্রছাত্রীদের বহিষ্কারাদেশ বাতিল করে রায় দেয় যে শিক্ষার অধিকার খর্ব করা যায় না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে রিট গ্রহণযোগ্য।
ভট্টাচার্যের আইনজীবী অভিষেক চিমনি যুক্তি দেন যে এসএউ আন্তর্জাতিক সত্তা হলেও ভারতীয় সংসদে পাশ হওয়া আইন (South Asian University Act, 2008) অনুযায়ী তাদের সীমিত পরিমাণ ইমিউনিটি আছে। তাই সম্পূর্ণভাবে আদালতের এক্তিয়ার অস্বীকার করা যায় না। তাঁর মামলার পরবর্তী শুনানি নির্ধারিত হয়েছে আগামী ১৮ নভেম্বর।
এসএউ-র প্রাক্তন অধ্যাপক শশাঙ্ক পেরেরা বলেন, “এই বিশ্ববিদ্যালয় এখন একপ্রকার বন্দিশিবিরে পরিণত হয়েছে, যেখানে ছাত্র-শিক্ষকের কোনো অধিকার নেই। ইমিউনিটি কখনও দায়মুক্তির হাতিয়ার হতে পারে না।” বাংলাদেশের এক পিএইচডি ছাত্র সুদীপ্ত দাস, যিনি এ বছরের জুলাই মাসে ‘অসদাচরণ’-এর অভিযোগে বহিষ্কৃত হয়েছেন, অভিযোগ করেন যে তাঁকে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলে অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মহাশিবরাত্রি উপলক্ষে মেসে নিরামিষ খাবারের বিতর্কে তিনি এবিভিপি-র টার্গেটে পরিণত হন। পরে প্রশাসন উল্টে তাঁকেই বহিষ্কার করে।
এসএউ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সার্কভুক্ত দেশগুলির যৌথ উদ্যোগে, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে। কিন্তু প্রাক্তন শিক্ষক ও ছাত্রদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয় আজ কার্যত এক ‘ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে’ পরিণত হয়েছে। হিন্দুত্বপন্থী প্রবণতা ও জাতীয় শিক্ষা নীতির ধাঁচে নতুন কোর্স চালুর অভিযোগও উঠেছে। বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি ক্রমশ কমছে। অধ্যাপক স্নেহাশীষ ভট্টাচার্যের চাকরি চলে যাওয়া শুধু এক ব্যক্তির কর্মজীবন নয়, বরং একটি আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র, স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক পরিসর নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। আদালতের পরবর্তী রায়ই নির্ধারণ করবে এই লড়াই কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।